অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকবে?-ভূমিকম্পের ঝুঁকি

ঈদ উৎসবের লগ্নেই সারা দেশ আবারও ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল। কম্পনের কেন্দ্র ছিল ঢাকার কাছেই। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ বিশ্বের যে ২০টি বড় শহরের ওপর জরিপ চালায়, তাতে দেখা গেছে, ঢাকাই সবচেয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগর। সম্প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী বিশ্বের দ্বিতীয় শহর হিসেবেও চিহ্নিত করেছে।


গোটা বাংলাদেশই নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির মুখে, তার মধ্যে প্রায় দেড় কোটি অধিবাসীর ঢাকা মহানগর গণমৃত্যুর কিনারে দাঁড়িয়ে বললে বেশি বলা হয় না।
গত শুক্রবার রাতের ভূমিকম্পটি ঢাকার বিপন্নতাকে আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ৪ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্প ছিল প্রকৃতির হুঁশিয়ারি। ঢাকা প্রাকৃতিক কারণে যতটা ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখে, তার থেকে অনেক গুণ বেশি দায়ী হলো ভবন নির্মাণে দায়িত্বহীনতা। দুর্বল স্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্যই ঢাকা এত বিপন্ন। আবাসন ব্যবসায়ীরা বিল-নদী-জলাশয় ভরাট করে এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে ভবন তুলে এই বিপন্নতাকে বহুগুণ বাড়াচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা মুনাফায় অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ হয়ে থাকবে না।
ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্পসহ প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর ওপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশের থাম ও কলাম দুর্বল। জাতিসংঘের সংস্থা আইএসডিআর বলছে, ঢাকার বৃহৎ কংক্রিট নির্মিত ভবনের ২৬ শতাংশের বেলাতেই প্রকৌশলগত বিধিমালা অনুসরণ করা হয়নি। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ঢাকার সাড়ে তিন লাখ ভবনের দুই লাখকেই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বড় শহরগুলোর অবস্থাও একই রকম।
এ বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্সে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে মারা যায় প্রায় তিন লাখ মানুষ। কাছাকাছি সময়ে চিলিতে আরও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলেও নিহত হয় প্রায় এক হাজার মানুষ। পোর্ট অ প্রিন্স ছিল ঢাকার মতো, কিন্তু চিলিতে ভবন নির্মাণ নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছিল বলে লাখো মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারও অল্প সময়ের মধ্যে তাদের অধিকাংশ বড় স্থাপনাকে ভূমিকম্পসহনীয় করেছে। অথচ বাংলাদেশের বেশির ভাগ হাসপাতাল ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনই বড় মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার মতো করে নির্মিত হয়নি। এসব কারণে ভূমিকম্পে যেমন, তার পরবর্তী দুর্যোগে আরও বেশি হতাহতের আশঙ্কা মারাত্মক। দুর্যোগের পরে ভবনের মধ্যে আটকে থাকা মানুষ উদ্ধার এবং শত শত কোটি টন ধ্বংসচূর্ণ সরানোর মতো প্রযুক্তিও অদ্যাবধি সংগ্রহ করা হয়নি।
আমাদের অবস্থা গ্রিক উপকথার অন্ধ জ্ঞানী তাইরেসিয়াসের মতো, যিনি বিপদের আভাস পান, কিন্তু প্রতিকারের ক্ষমতা তাঁর নেই। জেনেশুনে লাখ লাখ মানুষকে ভয়াবহ মৃত্যুর মুখে ফেলে রাখার থেকে বড় দায়িত্বহীনতা আর কিছু হতে পারে না। তাই সরকারকে এখনই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তা অপসারণ অথবা সংস্কার করা, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রযুক্তি সংগ্রহ, দক্ষ জনবল সৃষ্টি এবং অবকাঠামো নির্মাণে নেমে পড়তে হবে। সময় চলে যাচ্ছে, জীবন বাঁচাতে এখনই বড় আকারের উদ্যোগ হাতে নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.