খোলা চোখে-পাকিস্তানের ‘পাক’ কোথায়! by হাসান ফেরদৌস

একসময় পাকিস্তানিদের ঠাট্টা করে বলা হতো ‘ফান্ডোস’, অর্থাৎ ফান্ডামেন্টালিস্ট। সেই তকমা অবশ্য এখনো রয়েছে, নিজের দেশের বাইরে পাকিস্তানি নাম শুনলেই মানুষ সন্দেহের চোখে তাকায়। এখন সেই নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন তকমা—চিট।


চিট মানে জোচ্চোর। ইংল্যান্ড সফররত পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের তিন সদস্য ও দলের ক্যাপ্টেন পাতানো খেলার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত হয়েছেন। ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর অভিযোগ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সম্বন্ধে আগেও উঠেছে। এক-আধজন সেই অভিযোগে অল্পবিস্তর শাস্তিও পেয়েছেন। পুরোপুরি প্রমাণ না মেলায় সেই অভিযোগ সবাই সত্য বলে মেনে নেননি, অভিযুক্ত খেলোয়াড়েরা তো নয়ই। এবারের ব্যাপারটা কিঞ্চিত ভিন্ন। লন্ডনের নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকা একজন পাকিস্তানি দালালের মাধ্যমে চুক্তি করেছিল যে খেলার ফলাফল তাঁরা বদলে দেবেন। গোপনে রাখা ভিডিও ক্যামেরার সামনে কড়কড়ে টাকা গুনতে গুনতে লোকটি বলেছিলেন, ‘বস, কিচ্ছু ভাববেন না। দেখবেন যা যা বলেছি, ঠিক তাই হবে।’ হয়েছিলও তাই। খেলার ফলাফল তাঁরা কীভাবে বদলে দেবেন, তার প্রমাণ হিসেবে মাজিদ নামে সেই দালাল জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানি দলের উঠতি পেস বোলার মোহাম্মদ আমির তাঁর বোলিংয়ের তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বলটি নো বল করবেন। আর ঘটলও ঠিক ঠিক তা-ই। আমিরের পা বোলিং লাইনের এত দূরে পড়েছিল যে আম্পায়ার তাঁকে ডেকে সেই লাইন দেখান। মাইকেল হোলডিং বিবিসির হয়ে খেলার ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন। তিনি সবিস্ময়ে বললেন, ‘একি কাণ্ড! আমিরের পা এত দূরে গেল কী করে?’ সেই টেস্টে পাকিস্তান এক ইনিংস ও ২২৫ রানে যাকে বলে রীতিমতো গো-হারা হেরেছিল।
এই তিন খেলোয়াড়কে এখন সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। পুরো তদন্তকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। তবে প্রমাণ হাতেনাতে মিলে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা আইসিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপাতত তাঁদের অন্য কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অবশ্য যথারীতি ‘ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র’ বলে চেঁচানো শুরু করেছে। লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বলেছেন, পুরো ব্যাপারটাই বানানো। উদ্দেশ্য পাকিস্তানিদের হেনস্তা করা। দেশের ভেতরেও অনেকে এ নিয়ে সব দোষ বিলাতি পত্রিকাটির ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করেছে। কোনো ভারতীয় কানেকশন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। লতায়-পাতায় কোনোক্রমে সে রকম কোনো যোগাযোগ পাওয়া গেলে তো কেল্লাফতে। তখন পত্রিকার কলাম লেখক থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত এক সুরে চেঁচিয়ে বলবেন, সব দোষ ওই নচ্ছার ভারতের।
ক্রিকেট নিয়ে এই কেলেঙ্কারি ঘটল এমন এক সময়ে, যখন পাকিস্তান তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে। দেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভয়াবহ বন্যাকবলিত হয়েছে। বহুবর্ষণজনিত কারণে এর আগেও কমবেশি বন্যার ঘটনা পাকিস্তানে ঘটেছে, কিন্তু এমন ব্যাপক হারে নয়। কম করে হলেও দেশের এক লাখ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যাকবলিত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তানের ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার সেতু ভেঙে পড়েছে, যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তলিয়ে গেছে স্কুলঘর। দেশের অবকাঠামোর যে ক্ষতি হয়েছে, এর ফলে দেশটি কয়েক দশক পিছিয়ে যাবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক ত্রাণ বিশেষজ্ঞরা।
এই ব্যাপক বন্যা মোকাবিলায় পাকিস্তানের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। বন্যাকবলিত মানুষকে কীভাবে, কোথায় নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া যাবে তার কোনো ধারণাও তাদের আগে থেকে ছিল না। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এদিকে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে রীতিমতো কেলেঙ্কারি শুরু হয়েছে। ত্রাণ তৎপরতার দায়িত্বে আছেন সাবেক জেনারেল নাদিম। তিনি অভিযোগ করেছেন, সরকারদলীয় রাজনীতিকেরা ত্রাণ বিতরণে কেবল নাকই গলাচ্ছেন না, নিজের দলের সমর্থকদের জন্য যাবতীয় ত্রাণ দখলেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিদেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী কোথা দিয়ে কীভাবে লোপাট হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব মিলছে না।
একদিকে প্রকৃতির প্রতিশোধ, অন্যদিকে একই সময়ে ঘটে চলেছে একের পর এক তালেবানি হামলা। বিদেশের কাছ থেকে ভিক্ষান্ন না জুটলে দেশটি রসাতলে যাবে—এ কথা সবাই মানে। কিন্তু বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে পাকিস্তানি তালেবানরা জানিয়ে দিয়েছে যে বিদেশিদের সাহায্য তারা চায় না। যা সাহায্য দরকার, তারাই নাকি দেবে। বিদেশিরা সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের দেখে নেওয়া হবে বলে শাসিয়েছে তালেবান। কথামতো কাজও করেছে তারা। গত মাসে তাদের আক্রমণে সোয়াত উপত্যকায় তিনজন খ্রিষ্টান ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি ত্রাণকর্মীদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে।
দুর্ভোগের এখানেই শেষ নয়। এই অভাবিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও গেল দুই সপ্তাহে দেশের ভেতর একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে। লাহোরে ও করাচিতে শিয়াদের ওপর হামলায় শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে। এক লাহোরেই নিহত হয়েছে ১৮ জন, আহত হয়েছে ১৯০। পবিত্র রমজান মাসে এমন ঘটনা অভাবনীয়।
মৌলবাদী দলগুলো, যারা এই আক্রমণের দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে, তাদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, শিয়াদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এমন হামলা। কিন্তু তাদের অপরাধটা কী, তা অবশ্য খোলাসা করে বলেননি তাঁরা। শিয়া-সুন্নি দাঙ্গার পর করাচিতে এখন প্রতিদিন পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। এ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদেরাও পারস্পরিক কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন। আর পাকিস্তানে কোন্দল মানেই বন্দুক তুলে একে অপরকে খুন করা।
সব মিলিয়ে পাকিস্তানের এখন একেবারে লেজে-গোবরে অবস্থা। অন্য যেকোনো দেশে জাতীয় সংকটের মুখে দেশের মানুষ এককাট্টা হয়, সবাই হাত লাগায় মানুষের দুঃখ লাঘব করতে। পাকিস্তানে ব্যাপারটা উল্টো। সেখানে একে অপরের ওপর দোষারোপ করাটা একটা জাতীয় ক্রীড়া। এবারও সেই একই দৃশ্য। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অবস্থা সামলাতে পারছে না—এই যুক্তিতে মোজাহের কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) প্রধান আলতাফ হোসেন পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন, দেশের এই কঠিন সংকটের সময় জাতীয় স্বার্থে তাদের উচিত হবে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া। মানে আরেকটা ক্যু। হাস্যকর ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক দল হলো এই এমকিউএম। তারা যদি সরকারের ওপর সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে সরকারের পতন ঠেকানো অসম্ভব। তা না করে এই সময় আলতাফ ‘ভাই’ কেন সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানালেন, তা বোঝা খুব কষ্ট নয়। প্রেসিডেন্ট জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী জিলানির নেতৃত্ব নিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষই খুশি নয়। তার ওপর বন্যা যখন তুঙ্গে, তখন জারদারি সাহেব বেড়াতে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে (সেখানে তাঁদের পারিবারিক বালাখানা রয়েছে) ও ইংল্যান্ডে (সেখানে তাঁর ছেলে থাকেন)। জারদারির বিদেশে যাওয়া মানেই সঙ্গে চৌদ্দজন চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে দল বেঁধে যাওয়া। সবচেয়ে দামি হোটেলটি না পেলে তাঁদের আবার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। বলা বাহুল্য, সব সম্মানিত অতিথির তাবৎ খরচ মেটানোর দায়িত্ব দেশের সরকারের। এমনিতেই জারদারি সাহেবের জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায়। দেশের এই কঠিন সময়ে তাঁর এই অবকাশ ভ্রমণ কোনো মহলেই অনুমোদন পায়নি। তাঁর পদত্যাগের দাবি আগেও নানা মহলে উঠেছে, এবার সেই দাবি আরও জোরদার হয়েছে। কিন্তু নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটো বললেই তাঁকে হটানো যায় না। অতএব পাকিস্তানিদের কাছে যে পরীক্ষিত শর্টকাট পথটি রয়েছে, অর্থাৎ দেশপ্রেমিক সেনা ভাইদের আদর করে গদিতে বসানো, আলতাফ ভাই সে কাজটিই করার প্রস্তাব করেছেন। তারপর সত্যি সত্যি যদি সেই সব প্রেমিকজন গদি দখল করেই বসেন, তখন যেন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা যায়, আলতাফ হোসেন তা নিশ্চিত করতেই আগ বাড়িয়ে এমন প্রস্তাব রাখলেন।
পাকিস্তানের এই বেহাল অবস্থায় ভীষণ মন খারাপ করা মেজাজে আছে বিদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা। মানুষের গালমন্দ তাদেরই সহ্য করতে হয়। গেল সপ্তাহে করাচির ডন পত্রিকায় অস্ট্রেলিয়া থেকে আয়শা আমজাদ নামে এক আইনীজীবী সক্ষোভে লিখেছেন, আজকের যে পাকিস্তান, তার ভেতর ‘পাক’ জিনিসটা কোথায়? প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন: ‘হ্যাঁ, পাক (অর্থাৎ পিওর) যদি বলতে হতো, তো আমরা দুর্নীতিতে পিওর, পারস্পরিক ঘৃণার দিক দিয়ে পিওর, সহিংসতার দিক দিয়ে পিওর, অবিচার-অনাচারের দিক দিয়ে পিওর, অধঃপতনের দিকে দিয়ে পিওর।
একসময় এই তথাকথিত ‘পিওর’ পাকিস্তানের আমরা অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, সে কথা ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে। দেশটির দুর্ভাগ্যের আসল কারণ, তার ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ার সুযোগ সে পায়নি। যখনই তেমন কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, দেশপ্রেমিক ভাইয়েরা নিজেদের পাতানো খেলায় সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ করে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন। তাঁদের সেই খেলায় কখনো সমর্থনের হাত বাড়িয়েছেন পেশাদার রাজনীতিক, কখনো দেশের বিচারব্যবস্থা। এবারও সেই একই খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। কিন্তু খেলা শুরুর আগেই তাঁরা বমাল ‘কট’ হলেন, যেমন হাতেনাতে ‘কট’ হয়েছেন সে দেশের মহাসম্মানিত ক্রিকেটাররা।
পাকিস্তানের ‘পাক’ অনেক আগেই ছাঁটা পড়েছে। এখন যদি পাকিস্তান নামটি বদলে ‘ফাকিস্তান’ রাখা হয়, তাহলে বোধহয় খুব আপত্তির কিছু থাকবে না।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.