কর খাত-সম্প্র্রসারণের পাশাপাশি প্রয়োজন দক্ষ কর প্রশাসন by মামুন রশীদ

দেশের স্বার্থে যে কর খাতের সম্প্র্রসারণ এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব সচেতন মহলই একমত হবে। কর খাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা যত বেশি কর আহরণ করতে পারব, সরকারের পক্ষে ততই বেশি করে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া সম্ভব হবে।


সরকারের নিজস্ব রাজস্ব যত বেশি বৃদ্ধি পাবে, সরকার তত স্বাধীনভাবে এবং উপযুক্ত প্রাধিকারবলে যথাযথ দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে সম্পৃক্ত হতে পারবে। অর্থায়নের জন্য সরকারকে বিদেশি সাহায্য ও অনুদানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। কাজেই কর খাতের সম্প্রসারণ শুধু যে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্যই জরুরি, তা-ই নয় বরং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে, সমগ্র দেশবাসীকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য এটা দরকার। কিন্তু কেন আমরা কর খাতের সম্প্রসারণ করে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারছি না? আমাদের সমাজে কর ফাঁকি দেওয়ার এমন এক অপসংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যক্তিরা, এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনেক কর্তাব্যক্তি কেউই কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকম দুর্নীতির আশ্রয় নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। কর প্রশাসনের একশ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীও এই প্রবণতার সুযোগ নিয়ে থাকেন কিংবা উৎসাহিত করেন। শুধু কোণঠাসা হয়ে পড়েন সৎ কর্মকর্তারা, কেননা পরিস্থিতির ব্যাপক চাপ তাঁদের আইনানুগ নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে দেয় না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি যাঁরা সৎভাবে কর প্রদান করেও ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হন।
তবে কর খাতের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত নেতিবাচক কাজগুলোই শেষ কথা নয়, রয়েছে অনেক সাফল্যের ইতিহাসও। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত লক্ষ করলে দেখা যায়, গত দেড় দশকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অনেক সময় আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও গত এক দশকে প্রতিবছরই আগের তুলনায় রাজস্ব আদায় বাড়ছে। প্রতিবছরই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ছে। গত ১৫ বছরে রাজস্ব আদায় বেড়েছে প্রায় ৫০ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব হিসেবে আদায় করেছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। ১৫ বছর পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে সরকারের কর-রাজস্ব যেখানে ছিল ১৭০ কোটি টাকা, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকায়। সদ্য সমাপ্ত ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকায়। গত ১৫ বছরে আমাদের আয়কর আদায় বেড়েছে ১৫ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা, ভ্যাট আদায় বেড়েছে ১৪ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা আর কাস্টমস ডিউটি আদায় বেড়েছে পাঁচ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা।
এই বিস্তৃত পরিসংখ্যানগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাতে আমরা আমাদের প্রকৃত সম্ভাবনা এবং অর্জনকে উপলব্ধি করতে পারি। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাড়ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং মানুষের কর প্রদানের ক্ষমতা। গত ১৫ বছরের কর বৃদ্ধির পরিমাণ দেশের অর্থনীতির এই অর্জনকেই প্রতিভাত করে। এর সঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে কর প্রশাসন আধুনিকীকরণ (মূল্য সংযোজন করের প্রবর্তন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের কার্যক্রম ইত্যাদি)। বিশিষ্ট ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জয়রাম রমেশ নিজেই আমাকে কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ভারতকে বাংলাদেশের কাছ থেকে মূল্য সংযোজন করের সফল বাস্তবায়ন শিখতে হবে। তাঁর এই কথা শুনে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার বেশ ভালো লেগেছিল।
এসব সাফল্যের সব বৃত্তান্তের পরও আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর খাতের সম্প্রসারণ করে আরও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। এ জন্য আমাদের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে হবে। প্রথমত, আমাদের সমাজে কর ফাঁকি দেওয়ার যে ব্যাপক সংস্কৃতি বিদ্যমান আছে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনকারী বিভিন্ন আইন এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন সৎ করদাতা এবং সৎ কর আদায়কারী উভয়ই ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন। তৃতীয়ত, কর প্রশাসনকে ক্রমাগতভাবে আধুনিকীকরণ করে যেতে হবে, যাতে আরও দক্ষতার সঙ্গে সৎ করদাতাদের ভোগান্তি না ঘটিয়ে কর আদায়করণ সম্ভব হয় এবং অসৎ করদাতারা কর ফাঁকি দিতে না পারেন। তার সঙ্গে কর প্রশাসন কর প্রদানে প্রণোদনা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচার ও শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করতে পারে।
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কর ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি বহুল প্রচারিত। ব্যবসায়িক সংস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্ত সমাজের সব স্তরেই কর প্রদানে ব্যাপক অনীহা দেখা যায়। আমদানিকারকেরা তাঁদের পণ্যের মূল্য কম দেখান, বাড়ির মালিক তাঁর ভাড়া থেকে আয়ের পরিমাণ কম দেখান, রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী অনেকেরই বিত্তবৈভব কিংবা জীবনাচরণের সঙ্গে কর প্রদানের পরিমাণের কোনো মিল নেই, অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারই সম্পদ শ্বশুরালয় সূত্রে প্রাপ্ত—এ রকম উদাহরণ অহরহ দেখা যায় কিংবা শোনা যায়। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, তাঁরা কর দিতে চান না। কারণ, করের বিপরীতে তাঁরা পর্যাপ্ত সুবিধা সরকারের কাছ থেকে পান না। এ কথা সত্য, প্রত্যেক নাগরিক তার প্রদত্ত করের জবাবদিহি কামনা করতে পারে। দেশের নাগরিকদের মধ্যে কর প্রদানের প্রবণতা যত বাড়বে, প্রদত্ত কর কী উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হবে, তারও জবাবদিহি ঠিক সেভাবেই বাড়তে থাকবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের সংশ্লিষ্ট আইন প্রায় সময়ই সৎ কর আদায়কারী ও সৎ করদাতাদের প্রতি সদয় নয়। প্রায়ই দেখা যায়, সৎ করদাতা সৎভাবে কর দিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কিন্তু অসৎ করদাতা সহজেই আদালত ও আইনের সহায়তা নিতে পারছেন। আমার মনে আছে, বছর দশেক আগে আমার ব্যাংক-বিষয়ক একটি সমস্যার মীমাংসা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলাম। তৎকালীন চেয়ারম্যান আকবর আলি খান আমাদের সমস্যা শুনে বিদ্রূপের ছলে বলেছিলেন, ‘একটা কেস করে দেন, তাহলে আর চিন্তা করতে হবে না।’ পরে এও শুনেছিলাম, আদালতের দুর্বলতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে কর প্রশাসন বহু অসৎ করদাতাকে অভিযুক্ত করতে পারে না, সরকার বঞ্চিত হয় ন্যায্য আয় থেকে। অথচ একই কারণে সৎ করদাতাদেরও ভোগান্তির সীমা থাকে না।
কর প্রশাসনকে ক্রমাগতভাবে আধুনিক ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সৎ, মেধাবী ও সৃজনশীল লোক, তাঁরা যেন কর প্রশাসনে যোগ দিতে আকৃষ্ট হন। এসব মেধাবী লোক যাতে আরও দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, আরও সৃজনশীলতার সঙ্গে কর আহরণের জন্য দক্ষতর প্রশাসন তৈরি করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের ওপর নিরন্তর বিনিয়োগ করে যেতে হবে। আমি যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যেখানে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পারিশ্রমিক তার কর্মসাফল্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, যা গত বছর প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে, তার প্রধানের এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পারিশ্রমিকও তার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য বৃহৎ করদাতা ইউনিট এবং মূল্য সংযোজন কর বিভাগের ব্যাপারটিও। সেখানেও বিগত বছরগুলোয় বেশ কিছু ভালো অগ্রগতি হয়েছে। করদাতা এবং কর প্রশাসনের মধ্যে অনেক নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের কর প্রশাসন গেল বছরগুলোয় এগিয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে কর আদায় এবং গ্রাহকসেবায় এক ধরনের প্রণোদনা। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আমাদের সবার এই অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোনো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাই উচ্চাভিলাষী নয় বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনার কাছে। প্রয়োজন রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের ব্যক্তি উদ্যোগ ও নেতৃত্বের পাশাপাশি সামষ্টিক উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।

No comments

Powered by Blogger.