বিলেতের স্ন্যাপশট-টনি ব্লেয়ারের ‘আ জার্নি’ by শামীম আজাদ

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়েছিলেন ইরাকি সাংবাদিক আল জাইদি আর ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের প্রতি জুতো ছুড়েছে ডাবলিনের জনতা। বুশ বা ব্লেয়ার দুজনই জানতেন, ইরাক ও আফগান আগ্রাসনে তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে কী তীব্র প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে।


কিন্তু দুজনই ছিলেন বেপরোয়া। দুজনই অত্যন্ত গোঁড়া এবং বলা যায় ধর্মান্ধ। তাই এ ছিল তাঁদের ‘জিহাদ’!
হয়তো বুশের ঘটনায় ব্লেয়ার শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাই ডাবলিনে ছিল মাত্রাতিরিক্ত সতর্কতা। তার জন্য মহা ব্যয়বহুল এক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এমনকি দু-দুটো শপিংমল বন্ধ রাখতে হয়েছে। রাস্তা বন্ধ করে দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত করতে হয়েছে। তবু জড়ো হয়েছিল শতাধিক প্রতিবাদকারী। কিন্তু নিরাপত্তাবেষ্টনীর কারণে প্রতিবাদকারীরা তাঁর ধারেকাছে আসতে পারেনি। নিরাপত্তাকর্মীরা বৃষ্টিহীন দিনেও ছাতি মেলে ধরেন আর তাতেই বেঁচে যান রাজনীতির এই খলনায়ক। জনতার ছোড়া শূন্য পানির বোতল, ডিম আর পা থেকে খুলে নেওয়া জুতো উড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তাঁর গায়ে লাগে না। যা-ই হোক, এটা এখন ইতিহাস। এ আর তিনি মুছতে পারবেন না। যেমন মুছতে পারবেন না তাঁর হাত থেকে ইরাক আর আফগানিস্তানের রক্তের দাগ।
ঘটনাটি ঘটেছে তাঁর লেখা বই আ জার্নি বেরোনোর ঠিক তিন দিনের মাথায়। তাঁর বই বেরোলে মহা হইচই পড়ে যায়। কোনো সাবেক মাফিয়া বা ক্রিমিনালের বই পাবলিশড হলে যা হয়। লোকে জানতে চায়, কী খেলেছিল খুনির মাথায়। অথবা কেমন করে এত বড় অপরাধের পরিকল্পনা করেছিল। টনি ব্লেয়ারের সমালোচকেরাও জানতে চান, এই লোকের মাথায় কী খেলেছিল যে এত বড় একটা অকাণ্ডে তিনি সারা বিশ্বকে বিভাজিত করে দিলেন। সমালোচকেরা এবং যুদ্ধে নিহত ও আহত অনেকেরই ধারণা, একটি ব্যক্তিগত এজেন্ডা তাঁর ছিল। ধর্মান্ধতা। যেই না প্রধানমন্ত্রিত্ব গেল, অমনি তিনি ক্যাথলিক হয়ে গেলেন। এডিনবরায় পড়ার সময় গিটার নিয়ে শুরু করলেও অ্যাংলিকান পাদ্রি পিটার টমসন তাঁর ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেন। এবং সারা জীবনই লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী কিছু উদ্ভট ধর্মসভায় যেতেন। দেশে নিউ লেবারাইটদের তৈরি করে ১০ বছর প্রচণ্ড দাপটে রাজত্ব করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠেননি ভালো মানুষ গর্ডন ব্রাউন। যখন সারা দেশের মানুষ ব্লেয়ারের ওপর তিতিবিরক্ত এবং দেশ রিক্ত, তখন তিনি তাঁর খোসাটা ব্রাউনের হাতে ফেলে দিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু তখ্ত ছাড়তে চাননি। আর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, একবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তোমার কোনো ভালো প্লেয়ারকে রাখতে না চাইলে কী উপায়ে তাঁকে ছাঁটাই করো বলো দেখি? ব্রাউনকে তাঁর বইয়ে ‘বিলেতের জন্য বিপর্যয়’ বলেছেন। ভাবা যায়! এ যুদ্ধে তিনি গেছেন ১৩৯ এমপির ‘না’ ভোটের পরও।
টনি ব্লেয়ার ব্রিটেনের অর্থনীতি ও বহুজাতিক মিশ্রণে আবদ্ধ ব্রিটিশদের মধ্যে এমন এক বিভাজন সৃষ্টি করেছেন, যা চলবে বহুদিন। এ দেশের মানুষ ইরাক ও আফগানিস্তানের আগ্রাসনের পর অনেক বেশি নিরাপত্তা হারিয়েছে। প্রতিবেশী-প্রতিবেশীতে জন্ম নিয়েছে অবিশ্বাস। দাড়ি দেখলেই ভয় আর হিজাব দেখলেই সবকিছুর লয় ভাবছে আতঙ্কিত মানুষ। বিশ্ববিবেকের কাছে ব্রিটেনের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে!
একটি বই বেরোনোর পর সাধারণত প্রকাশকেরা বইটির প্রথম সংস্করণের বিষয়ে জনমত যাচাই করেন। তার জন্য লন্ডনের বাইরের কোনো একটি স্থান বেছে নেন। যাতে ঝামেলা কম হয় এবং বড় জায়গায় ছাড়ার আগে ভুলত্রুটি শুধরে ফেলা যায়। তাই প্রথম বইটি ছাড়া হয়েছিল ডাবলিনে। এদিকে অ্যান্টি ওয়ার ক্যাম্পেইনার ও স্টপ দ্য ওয়ার ক্যাম্পেইনাররা নিয়েছিল ব্যাপক প্রস্তুতি। সাবধানী প্রকাশক এখন ভাবছেন। ভাবছেন টনি ব্লেয়ারও। লন্ডনের অনুষ্ঠান তাই বাতিল হলো।
এমন যে হবে, তা তিনিও নিশ্চয়ই আঁচ করেছিলেন। ধূর্ত ব্লেয়ার আগেভাগেই বইয়ের লভ্যাংশ চার মিলিয়ন পাউন্ড ব্রিটেনের যুদ্ধাহত সৈনিকদের পুনর্বাসনের জন্য দান করে দেন। কিন্তু তাতেই শুরু হয় প্রথম সমালোচনা। কেউ কেউ বলছেন, এটা পাপ স্খলনের চেষ্টা। অথচ এখনো তিনি বলেন, ইরাক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর কোনো গ্লানি নেই! বাদবাকি বিক্রয়লব্ধ টাকাও ব্রিটিশ রয়্যাল লিজিয়নের জন্য দেওয়ার অঙ্গীকার করেন, তখন কিন্তু প্রশ্ন এসে যায়। এ অর্থ তাদের এবং তাদের পরিবারের কল্যাণেই যাবে, যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে এ যাবত্ যত যুদ্ধ করেছে। আনুমানিক তা হবে আরও ১৪ মিলিয়ন পাউন্ড। ব্রিটেনের ইতিহাসে এমন একক দান এর আগে আর কেউ করেননি।
ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সেস ফেডারেশনের চেয়ার ডালাস ইয়াং বলেছেন, যুদ্ধফেরত সব সৈনিকই তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ। মাথায় গুলিবিদ্ধ ও চিকিত্সারত ৩১ বছরের সাইমন ব্রাউন বলেছেন, এ তো দান নয়, এ তাঁর বিনিয়োগ। ল্যান্স কর্পোরাল শন শার্লি ইরাক যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো উপায়ে টনি ব্লেয়ারের প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। পিটার শার্লি বলেন, এই টাকায় রক্ত মেশানো, একদিন তাঁর ক্রিমিনাল কোর্টে বিচার হবেই।
ধর্মান্ধতার কারণে একাত্তরে বাংলাদেশে এমন পাপাচার হয়েছে যে পৃথিবীর ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। আমাদের দেশের সেসব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এখন ৪০ বছর পর বিচারের আওতায় নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রক্তের দাগ মোছা যায় না।
ধর্মের নামে কত বড় অধর্ম লোকটি করলেন। ইরাকে গণবিধ্বংসী সমরসজ্জা আছে বলে একটি ডাহা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ব্রিটেনকে ইরাক আগ্রাসনে লেলিয়ে দিলেন! জার্মানিতে হিটলারের হত্যাযজ্ঞে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে? আজ ইরাকি মৃতের সংখ্যার সঙ্গে আফগানিস্তানে ও ইরাকি সৈন্যের সংখ্যা যোগ করে দেখুন। কী দাঁড়ায়? এর সবই আপনারা জানেন। আরও জানেন, ব্রিটেন ও আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির মূল পরিবর্তন না করলে এ শুধু বাড়বে বই কমবে না। এখন তো বিলেতে জন্মলাভ করা ছেলেমেয়েরাই রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে ধরা পড়া মেধাবী ফয়সল তো বিলেতেই পড়াশোনা করে অমন জঙ্গি হয়ে উঠেছে। আর আমরা যত বেশি হিজাব, নেকাব, দাড়ি আর আলখেল্লা দেখি, তাদের জঙ্গি ও মৌলবাদী ভাবলেও ভুল হবে। এ হচ্ছে ‘পলিটিকস অব ভেইল’ বা বাহ্য ও নীরব প্রতিবাদের পোশাক।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
 শামীম আজাদ: কবি ও সাংবাদিক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.