প্রতিবেশ-অ্যানথ্রাক্স, শকুন ও প্রকৃতির আহাজারি by পাভেল পার্থ

নানা বঞ্চনা ও নিপীড়ন সত্ত্বেও সিরাজগঞ্জ ও পাবনার চলনবিল অংশের কৃষিনির্ভর ওরাঁও আদিবাসীরা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন নিজস্ব গোতার বা গোত্রব্যবস্থা। একেক গোত্রের একেক প্রতীক। এরকমই এক গিদহী গোত্রের গোত্র-প্রতীক হচ্ছে শকুনপাখি। নিজস্ব গোত্র-প্রতীক হিসেবে শকুনের রয়েছে ওরাঁও সমাজে এক বৈশিষ্ট্যময় সামাজিক মর্যাদা।


কিন্তু চলনবিল এলাকা থেকে শুরু করে দুনিয়াজুড়ে এই পাখিটি আজ অতি বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে হাওরাঞ্চল, বিল অঞ্চল, সুন্দরবন, সিলেটের বনাঞ্চল ও সমতলের গ্রাম-জনপদে একসময় শকুনের অবাধ বিচরণ থাকলেও আজ আর তেমনভাবে শকুন বা শকুন দলের দেখা মিলছে না। দেশের বাঙালি কি আদিবাসী—সব সমাজেই শকুনের উপস্থিতিকে গবাদিপশু-পাখি মড়কের প্রতিবেশীয় নির্দেশক হিসেবে পাঠ করা হয়। প্রতিবেশব্যবস্থার এই কিস্টোন প্রজাতিটি আমরা দিনে দিনে নিশ্চিহ্ন ও বিপন্ন করে তুলেছি। সাম্প্রতিক অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে এরই ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত। ওরাঁও আদিবাসীরা অ্যানথ্রাক্স রোগকে ‘পচামানিয়া রোগ’ হিসেবে চেনেন।
যে সিরাজগঞ্জ এলাকায় সাম্প্রতিক অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার ঘটেছে, সেখানকার আদিবাসী ওরাঁও প্রবীণদের ভাষ্যমতে, শকুন কমে যাওয়ার ফলেই ‘পচামানিয়া (অ্যানথ্রাক্স)’ রোগ এভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। আগে যখন বর্ষাকালে গরুর এই পচামানিয়া রোগ হতো, তখন আদিবাসী কবিরাজেরা কাঁচা হলুদ ও আতাফল পাতা বেটে গরুর চিকিৎসা করতেন। যেসব গরু মারা যেত, সেগুলো গ্রামের একটি নির্দিষ্ট জমিতে রেখে দেওয়া হতো। শকুনের দল সেসব মরা পশু খেয়ে গ্রামকে রোগমুক্ত রাখত। পচামানিয়া রোগ হলে অসুস্থ গরুকে সবার কাছ থেকে আলাদা রেখে এর বিশেষ যত্ন নেওয়া হতো এবং মানুষেরাও তখন বিশেষ স্বাস্থ্য পরিচর্যা করত। শকুনের সঙ্গে অ্যানথ্রাক্স রোগের এই জটিল প্রতিবেশীয় সম্পর্ক বিষয়ে ওরাঁও আদিবাসীদের মতো পুস্তকি বিজ্ঞানী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই একমত পোষণ করেন। শকুন যখন অ্যানথ্রাক্সে মারা যাওয়া গবাদিপশুর মাংস খায়, তখন তার পাকস্থলীর এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক এসিড গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স (Bacillus anthracis), বটুলিজম এবং কলেরা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে। ফলে গবাদিপশু থেকে অ্যানথ্রাক্স সহজে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে না।
ভারতে মানুষের অ্যানথ্রাক্স রোগ হওয়ার পেছনে শকুন কমে যাওয়ার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন গণপতি মুডুর (সূত্র: ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০১)। গণপতি মুডুর তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগে মৃত গবাদিপশু থেকে মানুষে অ্যানথ্রাক্স ছড়াচ্ছে। ২০০২ সালের ৭-১২ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনে এস দাশ শকুন এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্নতাকারী পাখিদের নিয়ে উপস্থাপিত তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, শকুন মানুষের ক্ষেত্রে অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়িয়ে পড়া দমন করে। দিল্লি পাবলিক স্কুলের সোনালী পট্টনায়েক, শালিনী দাস, মনীষা ভাস্করণ ও শুভংকর শর্মাও তাঁদের ‘শকুন বাঁচাও, বাস্তুসংস্থান বাঁচাও’ লেখায় জানিয়েছেন, শকুনেরা র‌্যাবিস ও অ্যানথ্রাক্স রোগবিস্তার রোধ করতে সহযোগিতা করে (সূত্র: http://www.bolokids.com/ 2008/0583.htm)|
প্রতিবেশের প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী এই শকুন নিশ্চিহ্ন হওয়ায় দেশের সামগ্রিক বাস্তুসংস্থানে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। শকুনের অনুপস্থিতি সাম্প্রতিক অ্যানথ্রাক্স বিপর্যয়ের মাধ্যমে স্পষ্টত প্রতিবেশের অসুস্থতাকেই হাজির করছে। বাসস্থান ও বিচরণ এলাকা কমে যাওয়া, বড় ও উঁচু দেশি গাছের সংকট, খাদ্যাভাব, শকুন-সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণ উদ্যোগের অভাবসহ শকুন কমে যাওয়ার পেছনে ডাইক্লোফেনাকও দায়ী।
ভারত-বাংলাদেশ অঞ্চলে ২০০৩ সালে ৯৫ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ শকুন কমে যাওয়ার পেছনে অনেকেই গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহূত ডাইক্লোফেনাককে দায়ী করেছেন। ডাইক্লোফেনাক গ্রহণকারী কোনো পশুর মাংস খেলে শকুনের শরীরে তা বিষক্রিয়া তৈরি করে এবং অসুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে পাখিটি মারা যায়। নেচার সাময়িকীর ২০০৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় পাকিস্তানে শকুনের বংশ কমে যাওয়ার পেছনে গবাদিপশু-পাখি চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহারবিষয়ক একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়। প্রথম আলো জানিয়েছে, দেশে বাংলা শকুনের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়ি চা-বাগান থেকে শকুন নির্বংশ হওয়ার জন্য ডাইক্লোফেনাক ওষুধের ব্যবহার, বন উজাড় ও খাদ্যসংকট দায়ী। ৫.৯.২০১০ তারিখে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চায়ের আবাদ সম্প্রসারণ করার সময় কিছু বড় গাছ কাটা এবং ঝড়ে কিছু বড় গাছ পড়ে যাওয়ার পর থেকে ফুলছড়ি চা-বাগান এলাকায় শকুনের আনাগোনা অনেকাংশে কমে গেছে। শকুন সংরক্ষণ ও শকুন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়।
সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা এলাকায় মূলত গরুর অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া অ্যানথ্রাক্স-বিপর্যয় থেকে বাঁচতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামগ্রিক প্রতিবেশীয় উদ্যোগ জরুরি। এটি কোনোভাবেই গবাদিপশুকে প্রতিষেধক দিয়ে বা মানুষকে রাসায়নিক ওষুধ খাইয়ে সারানো সম্ভব নয়। এ ঘটনা বাস্তুসংস্থানের অসুস্থতা ইঙ্গিত করছে। মূলত বাঁচাতে হবে প্রতিবেশব্যবস্থার নিজস্বতাকে, বাস্তুসংস্থানের ধারাবাহিক নিরন্তর বিকাশমান শৃঙ্খলাকে। অ্যানথ্রাক্স এবং গবাদিপশু থেকে ছড়িয়ে পড়া রোগ থেকে রক্ষার জন্য প্রকৃতিতে শকুনের মতো পাখি সংরক্ষণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। শকুন রক্ষা করতে হলে বাঁচাতে হবে দেশি বৃক্ষ-প্রজাতিসহ গ্রামীণ ও প্রাকৃতিক বনভূমি। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার, বিক্রি ও অনুমোদন আইনত বন্ধ করতে হবে। আশা করি, বন্য প্রাণী আইন, ২০১০ চূড়ান্তকরণের আগে শকুন সংরক্ষণে ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার বন্ধের জন্য আইনটিতে স্পষ্ট ধারা সংযুক্ত করা হবে। অ্যানথ্রাক্স-বিপর্যয়ের এই সময়ে দেশে কিছু মেগাশপ ‘অ্যানথ্রাক্সবিহীন’ গরুর মাংসের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। গরু পরীক্ষা করে মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ সার্বিকভাবে এর যেন সুরাহা চাইছেন না। এটিই প্রতিবেশ-রাজনীতির দর্শনগত ফারাক। অ্যানথ্রাক্স বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে শকুন, বনভূমি, দেশীয় বৃক্ষ-প্রজাতি, মানুষ, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য উপযোগী চিকিৎসা, লোকায়ত জীবনব্যবস্থা এবং সুশৃঙ্খল বাস্তুসংস্থান—সবকিছুকে একত্র করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, এরা সবাই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এক জটিল প্রতিবেশীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত। এদের একজন ছাড়া আরেকজনের জন্য কোনো একক সিদ্ধান্ত নিলেই আজ অ্যানথ্রাক্স, কাল হয়তো অন্য কিছু ছড়িয়ে পড়বে। প্রকৃতি তার শরীর ও মনের অসুস্থতাগুলো এভাবেই নানা বিপর্যয়ের মাধ্যমেই প্রকাশ করে। আশা করি, অ্যানথ্রাক্স-বিপর্যয়ের এই সময়ে দেশের প্রকৃতির করুণ অসুস্থ আহাজারি রাষ্ট্র অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে সচেষ্ট হবে।
পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.