মত দ্বিমত-এ ধরনের প্রকল্প জাতীয় স্বার্থের বিরোধী by বি ডি রহমতউল্লাহ

খুলনায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রস্তাবিত যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হবে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে দুটি অভিমত এখানে তুলে ধরা হলো।


ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলে ২×৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে বলে গত ৩০ আগস্ট দিল্লিতে একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এটি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পরপরই সরকার বিদ্যুতের তীব্র সংকটের মুখে পড়ে। অবশ্য তা ছিল পূর্ববর্তী সরকারগুলোর দুর্বিনীত দুর্নীতিরই ফল। অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে ও অল্প সময়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব। কিন্তু অতীতের সরকারের মতো এ সরকারও রেন্টাল বা মার্চেন্ট প্লান্টসহ বিদেশনির্ভর গর্হিত প্রকল্প নির্মাণে গেল এবং সমস্যাকে জিইয়ে রাখল। যেনতেনভাবে ফুলবাড়ীর কয়লা ও গভীর সমুদ্রের গ্যাসক্ষেত্র বিদেশিদের কাছে ইজারার পক্ষে জনমত গঠন, কৃত্রিম উপায়ে গ্যাস-সংকট সৃষ্টি করাসহ জ্বালানি খাতের সব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য একটাই—জ্বালানি খাতের ওপর বিদেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। ভারতের সঙ্গে খুলনা অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও এর অংশ।
এর বিস্তারিত বিবরণ এখনো জানা যায়নি। তবে সমঝোতা স্মারকে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হলো: ১. বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ভারতের এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে খুলনায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মিত হবে। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২. ব্যয়ের ৩০ শতাংশ দুই দেশ সমান ভাগে দেবে, বাকি ৭০ শতাংশ আসবে ভারত-প্রদত্ত ঋণ থেকে। ৩. অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা প্রস্তাবিত কোম্পানি নয়, ভারতের সরকারি সংস্থা এনটিপিসিই থাকবে এটির পরিচালনায়। ৪. এতে নিম্নমানের ভারতীয় কয়লা ব্যবহূত হবে, যা অতিরিক্ত কার্বন উদিগরণ করে এবং যাতে সালফেট, অ্যাশ ও ময়েশ্চার কনটেন্ট বেশি থাকার ফলে বায়ুদূষণ ঘটবে বেশি। মূলত এসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যই কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনে চীন ও ভারত সমালোচিত হয়েছিল। এতে অনেক বেশি কয়লা জ্বালিয়ে কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ৫. বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক চিহ্নিত পুরোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো এনটিপিসি সংস্কার করবে। অথচ এ দেশের প্রকৌশলীরা সম্ভাব্য ব্যয়সহ সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিও দিয়েছিলেন। ৬. এ কেন্দ্রের উচ্চ প্লান্ট ফ্যাক্টর নিশ্চিত করা অর্থাৎ অফ-পিক সময়ে পিডিবির কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে এ কেন্দ্র চালু রাখতে হবে। এতে পিডিবির স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতাও বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
বিএনপির আমলে ২০০৬ সালে ভারত বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার করে দিনাজপুরে এক হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং ঈশ্বরদীতে গ্যাস বা কয়লা দিয়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। সম্ভবত আর্থিক লাভালাভের দ্বন্দ্ব, সরকারের অভ্যন্তরীণ কোনো অংশের আপত্তি, একদল দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তার অনড় ভূমিকা ও তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় সমন্বয় কমিটির বিরোধিতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সে সময়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগও এর বিরোধিতা করেছিল। ওই খসড়া চুক্তিটিও এ জন্য অসম ছিল; কারণ—১. ভারতের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে অব্যাহতভাবে গ্যাস বা কয়লা জোগান দিতে বাধ্য হতো বাংলাদেশ। ২. দিনাজপুর বা ঈশ্বরদীতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধীনে যদি কোনো বড় শিল্প-কারখানা থাকে (যেমন ভারতের টাটা কোম্পানি একটি বড় ইস্পাত কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছিল), তাহলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমেই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গ্রাহক হিসেবে ওই কারখানাই পাবে। ৩. ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে যদি বাংলাদেশের কয়লা ও গ্যাস ব্যবহূত হয়, তাহলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য হবে কয়লার ক্ষেত্রে সাত টাকা এবং গ্যাসের বেলায় চার টাকা, যা ২০০৫ সালে আমাদের হিসাবে পিডিবি কর্তৃক উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণ।
বিএনপির আমলে ভারত ব্যর্থ হলেও আজ সফল হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ তাদের পরামর্শক ও ঠিকাদারি সেবা নিতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া পুরোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সংস্কার ও নবায়নের নামে এ দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ভারতের চাহিদামাফিক সাজানোর বন্দোবস্তও পাকা হবে।
কেন্দ্রটি নির্মাণে ভারত বাংলাদেশকে ঋণ দেবে। বিশ্বমন্দার এ সন্ধিক্ষণে ভারত একদিকে ঋণ-বাণিজ্য করছে, অন্যদিকে সেই ঋণের টাকা ব্যয় হচ্ছে তারই স্বার্থরক্ষার কাজে। একই ব্যাপার দেখা গেছে ট্রানজিটের বেলায়ও।
ভারতেই বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। তার চাহিদা যেখানে এক লাখ ৯০ হাজার মেগাওয়াট, সেখানে উৎপাদিত হয় এক লাখ ৫০ হাজার মেগাওয়াট। তাহলে ভারত কীভাবে এসব কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেবে?
এটি স্পষ্ট যে বিকল্প জ্বালানি (ফুয়েল ডাইভারসিফিকেশন) বিদ্যুতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। বরং অব্যাহত জ্বালানি পাওয়ার নিশ্চয়তাই বিদ্যুতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যেমন নরওয়েতে অঢেল তেল, গ্যাস, বায়ু ও পানি পাওয়া গেলেও সবদিক বিবেচনায় তারা ১০০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পানিসম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে। আমাদের দেশেও প্রচুর গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাকে বিবেচনায় এনে এ দেশের উর্বর জমি রক্ষার স্বার্থে প্রাপ্ত কয়লাকে ভূগর্ভেই গ্যাসীকরণ কিংবা কোল বেড মিথেন (সিবিএম) পদ্ধতি প্রয়োগের পরিকল্পনা হাতে নেওয়াই যৌক্তিক ও মঙ্গলজনক। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারও শ্রেয়তর।
অবাক করা ব্যাপার হলো, সমঝোতা স্মারকে বিদ্যুতের মূল্যের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। আশঙ্কা রয়েছে, বিদ্যুতের মূল্য ভারতই ঠিক করবে এবং কিছুতেই তা প্রতি ইউনিট ১০ টাকার নিচে হবে না। একদিকে ঋণের সুদ, অন্যদিকে সিংহভাগ বাংলাদেশি অর্থে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উচ্চমূল্যে কেনার চুক্তি করা খাল কেটে কুমির আনারই শামিল।
মহাজোট ক্ষমতায় এসেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যেভাবে তোড়জোড় শুরু করে, তাতে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর শেখ হাসিনার করা মন্তব্যটি মনে আসে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি জ্বালানি সম্পদ (সম্ভবত গ্যাস ও কয়লা) বিদেশে রপ্তানি করার শর্তে রাজি হতাম, তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচনে আমাদের এ পরাজয় হতো না। সহজ উক্তি এবং এর মর্মার্থও সহজবোধ্য।
বি ডি রহমতউল্লাহ: সাবেক মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল।

No comments

Powered by Blogger.