রস+আলো Fall উৎসব by আদনান মুকিত

৮ জুন, শুক্রবার। বার্ষিক ফল উৎসবে অংশ নিতে প্রস্তুত রস+আলো পরিবার। সব মিলিয়ে ৩৯ জন। আমাদের জন্য বাস, আর ফল ও ফল-সংশ্লিষ্ট দ্রব্যের জন্য মাইক্রোবাস। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সবাই সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়েছে। সবার গায়ে এক রকম টি-শার্ট।


বুকে মাসুদ রানার মতো সাহস না থাকলেও আছে রস+আলোর লোগোসমেত লেখা ‘Fall উৎসব’। পেছনে লেখা ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’। দেশে সিনেমা হল কমলেও কৌতূহল কমেনি। একই রকম টি-শার্ট পরা এতগুলো ছেলেমেয়ে দেখে মানুষের কৌতূহল জাগবেই। এক লোক জিজ্ঞেস করলেন,
—এত ফল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
—গাজীপুর, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে।
—ওখানে ফল নিয়ে কী করবেন?
—খাব।
—গাজীপুর যাওয়ার কী দরকার? ঘরে বসেই তো খাওয়া যায়।
—তা যায়। কিন্তু ফলগুলো অনেক দূর থেকে এসেছে তো। ওরা ফরমালিন দেখেছে। কিন্তু ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান দেখেনি। তাই খাওয়ার আগে ওদের একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সব ফল মাইক্রোতে উঠিয়ে আমরা বাসে উঠলাম। সাধারণত পাবলিক বাসে আমি সিট পাই না। এবার রিজার্ভ বাসেও পেলাম না। একেবারে পেছনে একটা সিট খালি। কী আর করা, স্কুলে সব সময় পেছনের সিটে বসেছি, বাসেও বসলাম। সৈয়দ রাকিব ভাই বসেছেন একেবারে সামনে; ওপরে লেখা ‘মহিলা’। মহিলা সিটে বসে সারাটা পথ উদাস হয়ে উনি কোনো মহিলার কথা ভাবছিলেন কি না কে জানে! হঠাৎ খেয়াল হলো, রকি ভাই আমাদের মাঝে নেই। উনি মাইক্রোবাসে পজিশন নিয়েছেন। সবার তো মাথায় হাত! শুধু জুনায়েদ ভাই দুই হাতে ক্যামেরা ধরেছিলেন বলে মাথায় হাত দিতে পারলেন না। রকি ভাইকে নিয়ে এত চিন্তার কারণ হলো, উনি একাই তিন-চার শ লিচু খেয়ে ফেলতে পারেন। নির্বিচারে লিচু খাওয়ার জন্য উনি এর আগেও অভিযুক্ত হয়েছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুযোগ পেয়ে এ দেশ কেড়ে নিয়েছিল, রকি ভাই ইস্ট ইন্ডিয়া না, তবে সুযোগ পেয়ে উনি যে পুরো ফলের গোডাউন কেড়ে নেবেন, তা কে না জানে? তবুও তিনি কীভাবে যে মাইক্রোতে স্থান পেলেন সে এক রহস্য! ভাগ্য ভালো, সৌরভ সাখাওয়াত ছিলেন। রকি ভাই সব লিচু খেয়ে ফেলবেন এই ভয়ে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে মাইক্রোর জানালা দিয়ে লিচুর একাংশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন।
ভাওয়াল উদ্যানে প্রবেশের ঠিক আগে বাস থামল। এ সুযোগে আমরা কয়েকজন চুরি করে বাসের ছাদে উঠে গেলাম। বাবা-মা প্রায়ই বলেন, ‘লেখাপড়া ছাড়া জীবনেও ওপরে উঠতে পারবে না।’ অথচ ওপরে উঠতে লেখাপড়া লাগল না, লাগল একটা সিঁড়ি। আজব দুনিয়া। ছাদে গিয়ে মনে হলো জীবন সুন্দর। কী বাতাস! কিন্তু বেশিক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগাতে পারলাম না। সিমু ভাই দেখে ফেলায় নেমে আসতে হলো ছাদ থেকে।
অবশেষে ল্যান্ড করলাম চমৎকার একটা জায়গায়। নেমে দেখি আমাদের জন্য ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি রেডি! নিজেকে যে-ই না রাজপুত্র ভাবতে যাব, অমনি শুনি, ওগুলো এখানকার স্থানীয়। ওদের পিঠে চড়তে হলে অর্থ ব্যয় করতে হয়। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে পুকুরঘাটে বসেছি, এমন সময় শুনি ঘোড়া ডাকছে। সিনেমা ছাড়া এই প্রথম বাস্তবে ঘোড়ার ডাক শুনলাম। যা শের শাহ চালু করেছিলেন। কবি বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে।’ কবির কথা আমরা ভুলে যেতে পারি, কিন্তু জুনায়েদ ভাই কী করে ভোলেন? ডাক শুনে আমরা কেউ গেলাম না, উনি ঠিকই ছুটে গিয়ে ঘোড়ার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করলেন। নতুন প্রজন্মের ঘোড়া তো, তাই ভয় পেয়ে পিছু হটল। আমরা ছবি তুলে ক্যাপশন ঠিক করলাম—ঘোড়ার সঙ্গে জুনায়েদ। বাঁ থেকে প্রথম!
তারপর শুরু হলো ফল খাওয়া! ফলের সমারোহ দেখে মনে হলো, এত ফল কে খাবে? কিন্তু খাওয়া শুরু করার পর মনে হলো, এত ফল কে খেল? কিছুক্ষণের মধ্যেই আম, লিচু, পেয়ারা শেষ! এক কোনায় লটকনের ব্যাগ পড়ে আছে। কেউ দেখেনি ভেবে লটকন মুখে দিয়েই বুঝলাম কেন লটকন তখনো শেষ হয়নি। ভয়ংকর টক! কোনোমতে একটা শেষ করে ঘোষণা দিলাম, আঙুর না, লটকন ফল টক! পাশের মাঠে তখন ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হয়েছে। ফলের লড়াইয়ে সুবিধা করতে না পেরে আমি যোগ দিলাম ব্যাট-বলের লড়াইয়ে। মাঠে তখন অ্যালুমিনিয়াম-ফাটা রোদ। মানে কাঠফাটা রোদের চেয়েও বেশি। অথচ আমি বলেছিলাম বৃষ্টি হবে। নিজেকে আবহাওয়া অফিসের কর্মী মনে হলো। তবে খেলতে গিয়ে দেখি সবাই বৃক্ষপ্রেমী হয়ে গেছে। কাছাকাছি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করে। খেলা শেষে গেলাম প্রজাপতির খামারে। শত শত প্রজাপতি উড়ছে দেখে ভালো লাগল। প্রজাপতি গবেষক আমাদের শব্দ করতে নিষেধ করলেন। শব্দে প্রজাপতিরা নার্ভাস হয়ে যায়। শুনে আমরাই নার্ভাস হয়ে গেলাম। হঠাৎ পাভেলের প্রশ্ন, প্রজাপতিদের কি দাঁত আছে? এরা কি কামড়ায়? আমি বুঝলাম পাভেল ক্ষুধার্ত। কারণ, টমাস ফুলার বলেছেন, খালি পেটে কোনো মানুষ বিচক্ষণ হতে পারে না।
পাভেলের কথা ভেবেই হয়তো দুপুরের খাবারের ডাক এল। ঘোড়ার ডাক উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু দুপুরের খাবারের ডাক কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। আমরা মহা-উৎসাহে খাওয়া শুরু করলাম। খাওয়ার পর বরাবরের মতো ফুটবল নিয়ে মাতলেন তাওহিদ মিলটন ও রাকিব কিশোর। গত বছর মিলটন ভাই একটি ফুটবল ফাটিয়েছিলেন। এবার বহু চেষ্টা করেও ফাটাতে না পেরে বললেন, বলটা ভালো না। বেশি শক্ত।
খেলা শেষ, ওদিকে বেলা শেষ। আমরা ভাওয়াল উদ্যানকে বিদায় জানিয়ে পার্শ্ববর্তী একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের ফল দিলাম। আশা করি ওদের পরীক্ষার ফল ভালো হবে। এবার ঢাকায় যাওয়ার পালা। আমরা আবারও ছাদে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় শুরু হলো বিতর্ক। আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে ওঠা নিয়ে বিতর্ক আছে, আমাদের ছাদে ওঠা নিয়ে তো থাকবেই। পাত্তা দিলাম না। কিন্তু সিমু ভাইয়ের আদেশ, কেউ ছাদে উঠবেন না। দুঃখ পেলেও এই ভেবে খুশি হলাম, আহা, সিমু ভাই আমাদের নিয়ে কত চিন্তা করেন। কিন্তু একটু পরই সে ভুল ভাঙল। তিনি বললেন, ‘আপনারা ছাদ থেকে পড়ে মারা গেলে লেখাটা কে লিখবে? কার্টুন কে আঁকবে?’ হায় রে কপাল! যা-ই হোক, সিমু ভাইয়ের কথা তো আর অগ্রাহ্য করা যায় না। লেখাটেখা যা লিখি ওনার হাত দিয়েই তো যায়। আমরা ছাদে উঠলাম না। সিটে বসে মনের দুঃখে গাইতে লাগলাম; ‘সেই সিমু ভাই কেন এত অচেনা হলেন...’
বি.দ্র.: যে টাকা ম্যানেজ হয়েছিল সে টাকায় আমরা সুস্থভাবে এবারের ফল উৎসব শেষ করতে পেরেছি—এই চিন্তা নিয়ে যখন রাতে আনন্দিত মনে ঘুমাতে যাচ্ছি, তখন সিমু ভাই ফেসবুক গ্রুপে জানালেন, টাকা তো সব শেষ, টি-শার্ট বানানো বাবদ সাত হাজার ৬০০ টাকা যে এখনো দেওয়া হয়নি, কে জোগাবে সেই টাকা! ভূতে, না গৌরী সেন?
ভাই ও বোনেরা আমার, যে যেখানে বসে এই লেখা পড়ছেন, আমাদের রস+আলো গ্রুপকে দেনার দায় থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। এটি একটি আকুল আবেদন।

No comments

Powered by Blogger.