এই দিনে-১৯৬২ সালের এই দিনটিতে... by সুরঞ্জিত বৈদ্য

তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। সেই মোতাবেক তিনি ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি কমিশনের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের সচিব এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইয়ুবের সাবেক শিক্ষক এস এম শরিফকে


চেয়ারম্যান করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছয়জন এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে চারজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এই কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের নামানুসারে এটির নামকরণ হয় ‘শরিফ কমিশন’।
১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন হিসেবে এই কমিশনের সুপারিশগুলো প্রেসিডেন্টের কাছে দাখিল করা হয়, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।
কমিশনের সুপারিশে অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে অবাস্তব কল্পনা বলে পরিহাস করা হয় এবং সর্বজনীন শিক্ষার গণদাবিকে নির্বিচারে ব্যঙ্গ করা হয়। স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার কর্তৃক ঘোষিত এই অগণতান্ত্রিক ‘শরিফ কমিশন’ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা বাংলার ছাত্রসমাজ সেদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। উত্তাল সমুদ্রের মতো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-মিছিলে ১৯৬২ সালের আজকের এই দিনে পুলিশ গুলি চালালে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহসহ অনেকে শহীদ হন। আহত হন অসংখ্য ছাত্র-জনতা।
স্মর্তব্য যে এর মাত্র কয়েক বছর আগে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। জাতীয় ভাষা ও জাতীয়তার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান তখনো সরগরম। সেই মুহূর্তে আইয়ুব সরকার কর্তৃক ঘোষিত ‘শরিফ কমিশন’ শিক্ষানীতি ছিল এ দেশের ছাত্রসমাজের কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতোই অবস্থা। ছাত্রসমাজ সঙ্গে সঙ্গে ‘শরিফ কমিশন’ প্রতিবেদনকে একটি অগণতান্ত্রিক, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা এতে অংশ নেয়। তবে আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন ঘটে ১৯৬২ সালের ১০ আগস্ট। এদিন বিকেলে ঢাকা কলেজ ক্যানটিনে স্নাতক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্ররা এক সমাবেশে মিলিত হন। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কাজী ফারুক আহমেদ। ১০ আগস্টের এই সভায় ১৫ আগস্ট সারা দেশেই ছাত্রদের সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং দেশব্যাপী ছাত্রসমাজের কাছে তা ব্যাপক সাড়া জাগায়। এরপর আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৫ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এ লক্ষ্যে বেশ কটি ছাত্রসভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ফলে আন্দোলন ধীরে ধীরে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো দানা বাঁধতে থাকে।
যে আন্দোলন এত দিন সীমাবদ্ধ ছিল স্কুল-কলেজগুলোয়, আজ তা চলে এল বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায়। ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ নাম দিয়ে এ আন্দোলন শুরু হলেও পরে তা ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’ হয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’-এ রূপ নেয়।
পূর্বনির্ধারিত ১০ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘটের দিন সকালেই পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এক প্রেসনোটের মাধ্যমে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘট থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়, অন্যথায় পরিস্থিতি মারাত্মক হবে বলে হুমকিও দেয়। কৌশলগত কারণে ছাত্রসমাজ সেদিন ১০ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও ১৭ সেপ্টেম্বরে হরতালের ডাক দেয় এবং এর পক্ষে প্রতিদিন প্রচারণা চালাতে থাকে। পথসভা, খণ্ডমিছিলসহ ব্যবসায়ী সমিতি, কর্মচারী সমিতি, রিকশা ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গেও ছাত্রনেতারা যোগাযোগ করতে থাকেন। ১৭ সেপ্টেম্বর খুব সকাল থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় রাস্তায় পিকেটিং শুরু করেন। পিকেটিংয়ের আওতায় পড়ে কার্জন হলের সামনে মোনায়েমের মন্ত্রিসভার সদস্য হাসান আসকারির গাড়ি ভস্মীভূত হয়। ওই সময় দু-তিনটি পুলিশের জিপও পোড়ানো হয়। রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভকারী মানুষের ঢল নামে। দেখতে দেখতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এমন সময় খবর এল, নবাবপুরে গুলি হয়েছে এবং গুলিতে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় জঙ্গি মিছিল। উত্তাল সমুদ্রের মতো সেই জঙ্গি মিছিলে নেতৃত্ব দেন কাজী জাফর আহমদ, সিরাজুল আলম খান, মহিউদ্দিন আহমেদ, মফিজুর রহমান, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, আইয়ুব রেজা চৌধুরী, রেজা আলী প্রমুখ। মিছিল যখন হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গনি রোডে প্রবেশ করছিল, তখন মিছিলের পেছনে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে সেদিন ঘটনাস্থলেই বাবুল ও গোলাম মোস্তফা নিহত হন। ওয়াজিউল্লাহ গুলি খেয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পরের দিন হাসপাতালে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। আহত হন অনেকেই। এ ঘটনা বিক্ষোভকারীদের আরও জঙ্গি করে তোলে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন এবং ছাত্র-অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনের মধ্যে সরকার ‘শরিফ কমিশন’ রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়।
এর ফলে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ে। এ বিজয় ছাত্রসমাজ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দেয়। শুধু শিক্ষাবিষয়ক ব্যাপার নিয়ে যে এত ব্যাপক ও বিশাল ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, তা ছিল ছাত্রনেতাদের জন্য একটি বিরাট শিক্ষা। মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার যে বীজ বপন করে, সেই বীজ ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনে অঙ্কুরিত হয়ে জাতীয় চেতনার সঙ্গে প্রগতিশীলতার স্ফুরণ ঘটায়; যার ফলে এ দেশের ছাত্রসমাজ স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।

No comments

Powered by Blogger.