বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪২২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। ফজলুল হক, বীর প্রতীক সফল যোদ্ধা ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিক। টাঙ্গাইলে যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন দলনেতা খবর পেলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে কয়েকটি জলযান রংপুরে যাচ্ছে। তাতে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে।


প্রতিটি জলযানেই আছে পাকিস্তানি সেনা। তারা পাহারায় নিযুক্ত।
দলনেতা সবাই কাদেরিয়া বাহিনীর। এর সামরিক প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) ফজলুল হকসহ অন্যান্য দলনেতার কাছে ওই খবর পাঠিয়েছেন। এরপর কয়েকটি দলের সমন্বয়ে একটি দল গঠিত হলো। নেতৃত্বে হাবিবুর রহমান (বীর বিক্রম)।
ফজলুল হকসহ অন্য যোদ্ধারা প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান নিলেন মাটিকাটায়। টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুরের দক্ষিণের একটি গ্রাম মাটিকাটা। এর পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদী। তারপর দিন গড়াতে থাকল।
৯ আগস্ট খবর এল ভূঞাপুরের অদূরে সিরাজকান্দি ঘাটে জলযানগুলো নোঙর করেছে। ছোট-বড় মোট সাতটি জাহাজ ও স্টিমার। ১১ আগস্ট সকালে গুপ্তচর মারফত মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেলেন, সব জলযান আবার যাত্রা শুরু করেছে। সেগুলো তাঁদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
ফজলুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে দ্রুত অবস্থান নিলেন নদীর তীরে। বেলা আনুমানিক ১১টা। এমন সময় জলযানগুলো চলে এল তাঁদের কাছাকাছি।
তাঁরা অবস্থান নিয়েছেন নদীর পূর্ব পাড়ে। জলযানগুলো সেই পাড়ের পাশ দিয়েই এগিয়ে আসছে। নদীর পাড় থেকে একটু দূরে চর। জলযানগুলো নদীর পাড় ও চরের মাঝ দিয়েই যাবে।
হাবিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছেন, তিনি সংকেত দেবেন। তার আগে যেন কেউ গুলি না ছোড়ে। তাই ফজলুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা অস্ত্রের ট্রিগারে আঙুল রেখে চুপচাপ আছেন। সময় এগিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে দুটি জলযান তাঁদের সামনে দিয়ে চলে গেল।
ফজলুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা সবাই অধীর উত্তেজনায়। কিন্তু সংকেত আসছে না। এমন সময় বড় আকারের দুটি জলযান তাঁদের সামনে এল। তাঁরা দেখলেন তাতে মেশিনগান ফিট করা। কিন্তু সেখানে কোনো পাকিস্তানি সেনা নেই। সেনারা ডেকে শিথিল অবস্থায় গল্পগুজব করছে। মৃত্যু যে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা তাদের কল্পনাতেও নেই।
ঠিক তখনই সংকেত এল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল ফজলুল হকসহ সবার অস্ত্র। মর্টার, এলএমজি, রাইফেলের গুলিবর্ষণ। একের পর এক রকেট লঞ্চারের রকেট পড়তে থাকল কেবিন ও ডেকে। হতাহত হলো পাকিস্তানি সেনাসহ কয়েকজন। বাকিরা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে স্পিডবোটে চড়ে পালিয়ে গেল। পেছনে ছিল আরও তিনটি জলযান। সেগুলো গোলাগুলির শব্দ শুনে মুখ ঘুরিয়ে পেছন দিকে চলে গেল।
আক্রান্ত জলযানে ছিল অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের বাক্স। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামবাসী ও স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় অর্ধেক বাক্স নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হন। এরপর তাঁরা তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে জলযান এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস হয়ে যায়।
১৩ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাটিকাটায় বিমান হামলা চালায়। তখন ফজলুল হক আহত হন।
ফজলুল হক ১৯৭১ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অনেক স্থানে তিনি যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য ফজলুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪১৫।
ফজলুল হকের পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলা শহরের বেতকা কলেজ পাড়ায়। তাঁর বাবার নাম ওসমান গনি তালুকদার, মা লাইলি বেগম, স্ত্রী নাজমা হক। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: টাঙ্গাইলে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কামনাশীষ শেখর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.