১১ সেপ্টেম্বরের হামলা-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টতই বাড়াবাড়ি রকমের by ফরিদ জাকারিয়া

১১ সেপ্টেম্বর হামলার নয় বছর পেরিয়ে এসে কারও মনে কি কোনো সন্দেহ আছে যে আল-কায়েদা আসলে ততটা সাংঘাতিক হুমকি নয়? ২০০১ সালের সেই বিভীষিকাময় দিন থেকে সারা দুনিয়ার সরকারগুলো সন্ত্রাসবাদবিরোধী পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে।


তার পর ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ কোনো লক্ষ্যবস্তুতে বড় ধরনের একটাও হামলা চালাতে পারেনি। যদিও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি জিহাদি গোষ্ঠীকে ছোট মাপের কিছু হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে, কিন্তু আল-কায়েদা নিজে কোনো হামলা চালাতে পারেনি। আল-কায়েদা আজ সর্বোচ্চ যা আশা করতে পারে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে চরমপন্থার দিকে ঝোঁক তৈরি হওয়া কোনো উদ্ভ্রান্ত যুবককে তার অন্তর্বাসে বিস্ফোরক ভরে নেওয়ার শিক্ষা দেওয়া।
আল-কায়েদার বর্বরোচিত অভিসন্ধি আমি এখানে খাটো করে দেখছি না। কিন্তু তাদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। সাম্প্রতিককালের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি সংঘর্ষে তার শত্রুদের খারাপ অভিপ্রায় যদিও ঠিক ধরতে পেরেছিল, কিন্তু শত্রুর শক্তিকে অত্যন্ত বাড়িয়ে দেখেছে। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তি ও প্রভাব বাড়াচ্ছে, অথচ তখন দেশটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল, সাদ্দাম হোসেনের পরমাণু অস্ত্রাগার রয়েছে। বাস্তবে তাঁর কারখানাগুলোয় সাবান বানানোই ছিল কঠিন।
পরেরবার ভুলটি ছিল আরও ক্ষতিকর। আমেরিকান চৈতন্যে ও আমেরিকান ব্যবস্থায় ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা ছিল বড় আঘাত। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রকে কেমন করে বদলে দিয়েছে, তা নিয়ে দুই বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন ওয়াশিংটন পোস্ট-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকল্প ‘টপ সিক্রেট আমেরিকা’য় ডানা প্রিস্ট ও উইলিয়াম আরকিন। এ প্রকল্পে পাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নানা দিক মোকাবিলা করার জন্য ২৬৩টি সংস্থা সৃষ্টি বা পুনর্গঠন করেছে। গোয়েন্দা কাজে ব্যয় বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। অনেক কম করে দেখানো প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী ব্যয়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এই পরিমাণ অর্থ বাদবাকি দুনিয়ার সব দেশ মিলেও খরচ করে না। গোয়েন্দাদের প্রশাসনিক কাজের জন্য ৩৩টি নতুন ভবন কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। এতে জায়গা লেগেছে ১ কোটি ৭০ লাখ বর্গফুট, যা যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি কংগ্রেসভবন কিংবা তিনটি পেন্টাগনের সমতুল্য। ৫০ বছরের মধ্যে সর্ববৃহৎ সরকারি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে হোয়াইট হাউসের পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। খরচ হয়েছে ৩৪০ কোটি ডলার। পেন্টাগন এবং ডিপার্টমেন্ট অব ভেটেরান অ্যাফেয়ার্সের পর সবচেয়ে বড় আমলাতন্ত্র ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির স্থান সংকুলানের জন্য এটা তৈরি করা হয়েছে। এই ডিপার্টমেন্টের কর্মীসংখ্যা দুই লাখ ৩০ হাজার।
এই নতুন ব্যবস্থায় প্রতি বছর ৫০ হাজার প্রতিবেদন তৈরি হয়—প্রতিদিন গড়ে ১৩৬টি। এর অর্থ হলো, অতি নগণ্যসংখ্যক প্রতিবেদনই পঠিত হয়। যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ ধরনের প্রতিবেদন পড়েছেন, তাঁরা এগুলোকে মামুলি বা গতানুগতিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমাকে একজন বলেছেন, ‘গুগল ব্যবহার করে প্রতি ঘণ্টায় এমন অনেক প্রতিবেদন তৈরি করা যায়।’ ১৫টি অঙ্গরাজ্যে ৫১টি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক দপ্তর সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অর্থ লেনদেনের গতিবিধির ওপর নজরদারির কাজ করে। কিন্তু এদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান ঘটে খুব কমই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ফোনালাপ ও অন্যান্য যোগাযোগের ওপর শুধু নজরদারির জন্য এখন প্রায় ৩০ হাজার কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। তবু কোনো সামরিক গোয়েন্দাদের নজরে পড়েনি মেজর নিদাল মালিক হাসান তাঁর প্রশিক্ষণকেন্দ্র ওয়াল্টার রিড আর্মি মেডিকেল সেন্টারে একের পর এক অদ্ভুত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন। নাইজেরিয়ার ‘ক্রিসমাস বোমারু’র পিতা তাঁর সন্তানের চরমপন্থার প্রতি ঝোঁকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু এ বিস্তৃত নিরাপত্তাযন্ত্রের ভেতর ঠিক মানুষদের কাছে সেই বার্তা কোনোদিন পৌঁছেনি। বোমারুর নিজের অযোগ্যতা ও কয়েকজন সতর্ক যাত্রীর কারণে সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়।
এমন ভুল হয়তো পার পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা-রাষ্ট্রের উত্থান সরকারের ক্ষমতার বিরাট বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রবাসীর জীবনের সব দিককে সেই ক্ষমতা স্পর্শ করে, যদি তা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কহীনও হয়। ডেভ এগারসের হূদয়বিদারক বই জাইতুন-এর উল্লিখিত সবচেয়ে হতোদ্যমকর দিক হলো, হারিকেন ক্যাটরিনার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের দ্রুততম ও সবচেয়ে কার্যকর প্রতিক্রিয়া ছিল, গুয়ানতানামোর মতো একটি বন্দিশালা তৈরি (কয়েক দিনের মধ্যেই এটা বানিয়ে ফেলা হয়!)। ১২০০ মার্কিন নাগরিককে স্বল্প সময়ের জন্য এখানে আটক করে রাখা হয়। কয়েক মাস ধরে তাঁরা সাংবিধানিক অধিকার বঞ্চিত থাকেন, তাঁদের হেবিয়াস করপাস নেওয়ার অধিকার স্থগিত করা হয়। অবস্থাটা ছিল অনেকটা কাফকার উপন্যাসের কাহিনির মতো।
অতীতে মার্কিন সরকার যুদ্ধের জন্য ক্রমান্বয়ে শক্তি বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, জরুরি পরিস্থিতিকালীন কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছে, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ক্ষমতার অপব্যবহারও করেছে। তবে যুদ্ধের পর সব সময় এ ক্ষমতা গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এবার এমন এক যুদ্ধ চলছে, যার কোনো শেষ নেই। কখন যুক্তরাষ্ট্র বিজয় ঘোষণা করবে? জরুরি পরিস্থিতিকালীন কর্তৃত্বের অবসান কখন ঘটবে?
অঙ্গরাজ্যের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধিতে রক্ষণশীল ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচিগুলোর চেয়ে এই শক্তি বৃদ্ধি নিশ্চয় অনেক উদ্বেগজনক। জেমস ম্যাডিসন এ বিষয়টি বিবেচনা করে একটি সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছান, ‘জনগণের স্বাধীন জীবনযাপনের শত্রুদের মধ্যে যুদ্ধই হয়তো সবচেয়ে ভীতিকর। যুদ্ধের সময়ও নির্বাহী বিভাগের অবাধ ক্ষমতার বিস্তার ঘটে?.?.?
ম্যাডিসনের সিদ্ধান্ত হলো: ‘অবিরাম যুদ্ধের মধ্যে কোনো জাতি জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেনি।’
নিউজউইক থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
ফরিদ জাকারিয়া: নিউজউইক ইন্টারন্যাশনালের সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.