ঈদের পর কঠোর কর্মসূচি!-বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ আজ নয়াপল্টনে

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপির দেওয়া ৯০ দিনের আলটিমেটাম শেষ হয়েছে গতকাল রবিবার। ওই দাবির প্রতি সরকার গুরুত্ব না দেওয়ায় সরকারকে আবারও সময় বেঁধে দিতে চায় প্রধান বিরোধী দল। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামনে রমজান মাস, সেই সঙ্গে বর্ষা মৌসুম।


এ মৌসুমে আন্দোলন জোরদার করা কঠিন। সেই চিন্তা থেকেই জনগণ ক্ষুব্ধ হয়- এমন কর্মসূচি দিতে চায় না দলটি। সে ক্ষেত্রে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে বিক্ষোভ, জনসংযোগ ও জনসভা ছাড়া বড় ধরনের কর্মসূচি নাও দিতে পারে বিএনপি। ঈদের পর হরতাল, রেলপথ-সড়কপথ অবরোধসহ নানা কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। এসব কর্মসূচি আজকের জনসমাবেশ থেকে কিংবা পরেও ঘোষণা করা হতে পারে। তবে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নেতাদের মুক্তি বিলম্বিত হলে আগেও হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে বলে জানান দলীয় নেতারা।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগও চালিয়ে যাবে বিএনপি নেতৃত্ব। বিএনপি ও জোটের নেতারা জানান, এ লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা চালাবে বিএনপি। এসব চিন্তা মাথায় রেখেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আজ সোমবার নয়াপল্টনের জনসমাবেশ থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। জনসমাবেশ শুরু হবে দুপুর ২টায়।
কী কর্মসূচি আসতে পারে, জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জনগণের দুর্ভোগ হোক- এমন কোনো কর্মসূচি কখনো দেয় না বিএনপি। এবারও তাই হবে। সামনে রমজান মাস ও বর্ষা মৌসুম। রমজান মাসকে আমরা খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ রোজার পরই ঈদ। ঈদ সামনে রেখে জনগণ ক্ষুব্ধ হোক- এমন কোনো কর্মসূচি হয়তো থাকবে না।' তিনি আরো বলেন, যে নামেই হোক না কেন, সরকারের উচিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি মেনে নেওয়া। কারণ এই দাবি শুধু বিএনপির নয়, এটা এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। জনগণের এই দাবি মেনে না নিলে ঈদের পর হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আসতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি আসার সম্ভাবনা কম। সরকার যদি পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলে তাহলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। অন্যথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে স্বাভাবিক কর্মসূচিই থাকবে। হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে ওই নেতা বলেন, সামনে রমজান মাস এবং বর্ষা মৌসুম। এ সময় আন্দোলন জোরদার করা কঠিন হবে। রমজান মাসে হরতালের মতো কর্মসূচি থাকলে জনগণ ক্ষুব্ধ হতে পারে। তাই রমজানের আগে কঠোর কর্মসূচি থাকার সম্ভাবনা কম।

১৫ লাখ লোক জমায়েতের আশা : আজকের জনসমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু করে মধ্যরাতে শেষ হয়। দলীয় কার্যালয়ের সামনে ও আশপাশে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সমাবেশ সফল করার ব্যাপারে গতকাল বিকেলেও নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা।
বৈঠকের পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জনসমাবেশের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে সরকার মৌখিকভাবে। তিনি বলেন, নয়াপল্টন ছাড়াও মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, পল্টন মোড়, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, শান্তিনগর পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, 'সমাবেশে ১৫ লাখ লোকের উপস্থিতি আশা করছি।' ঢাকা মহানগরীর সব ওয়ার্ড এবং ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে বেশি লোকজন উপস্থিত হবে বলে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সারা দেশের যাদের সক্ষমতা আছে, তারাও আসবে।
তরিকুল বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের ভূমিষ্ঠ করা সন্তান। খালেদা জিয়া একে লালনপালন করেছেন। আমরা কিছুতেই একে হত্যা করতে দেব না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে এই সরকারকে বাধ্য করা হবে।' পরবর্তী কর্মসূচি কী আসছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রমজান খুব কাছাকাছি। এ ছাড়া বিএনপি সংঘাত চায় না। তাই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে। সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান তরিকুল।
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান পটল, মোহাম্মদ শাহজাহান, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, আবদুস সালাম, সংসদ সদস্য শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আবুল খায়ের ভুঁইয়া প্রমুখ।
জনসমাবেশের অনুমতি : নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি মৌখিকভাবে দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, সমাবেশ করার জন্য সরকার মৌখিক অনুমতি দিয়েছে। লিখিত অনুমতিও দেবে- এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অঙ্গীকার দেওয়ার সূত্রে ডিএমপি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে এই জনসমাবেশের অনুমতি দিয়েছে।
জনগণের বিজয় : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, শেষ মুহূর্তে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ায় জনগণের বিজয় হয়েছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত প্রচারপত্র বিলির সময় তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। আজকের জনসমাবেশের পক্ষে বিএনপি সমর্থক সংগঠন স্বাধীনতা ফোরামের উদ্যোগে এই লিফলেট বিতরণ কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়।
ব্যাপক প্রস্তুতি : সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান গতকাল রাজধানীর মালিবাগ-মৌচাক-মগবাজার এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সমাবেশ বানচাল করতে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে সমাবেশের অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে। এ কারণে সাময়িকভাবে অসুবিধা হলেও লাখ লাখ মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সরকারের এ আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় জবাব দেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান অভিযোগ করে বলেন, ১২ মার্চের মতো এবারও সমাবেশ আয়োজনে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোকে রবিবার ও সোমবার যাত্রীবোঝাই করে ঢাকায় না ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও নোয়াখালীতে কর্মীবাহী গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সমাবেশ ঘিরে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও ডিজিটাল স্ক্রিন তৈরির কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এসব সামগ্রী রাখা হয়েছে দলীয় কার্যালয়ের নিচে। গতকাল সকাল থেকে কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। দুপুরে সেখানে কয়েক শ নেতা-কর্মীকে দেখা যায়। ঢাকার বাইরে থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মী এসেছেন। আশপাশের জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা আজ সরাসরি সমাবেশে যোগ দেবেন। মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম জানান, সমাবেশে খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেখানোর জন্য নয়াপল্টনের বিভিন্ন সড়কে চারটি স্থানে বড় পর্দা লাগানো হচ্ছে।
এদিকে ওই এলাকায় মাইকও লাগানো হয়েছে শতাধিক। নেতাদের মুক্তির দাবিতে টানানো ব্যানারে ছেয়ে গেছে নয়াপল্টন এলাকা। বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রায় ৫০০ নেতা-কর্মী। কয়েক শ স্বেচ্ছাসেবকও কাজ করবেন। মঞ্চ এবং এর সামনে যাঁরা বসবেন তাঁদের মধ্যে ডেলিগেশন কার্ড বিতরণ করা হয়েছে গতকাল সকাল থেকে। সমাবেশের পুরো কার্যক্রম দুপুর ১টা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি।
সমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম করতে প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাপ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপা, লেবার পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। কয়েক দিন থেকেই তারা দলীয়ভাবে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। এদিকে আজকের জনসমাবেশ সফল করতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
সমাবেশের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হালিম কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াত ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে পাঁচ লাখ লোকের সমাগম করার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.