পুলিশ এবার বিচারকের গায়ে হাত তুলল-নরসিংদীতে তিন পুলিশ প্রত্যাহার by সুমন বর্মণ

এবার এক বিচারককে লাঞ্ছিত করেছে পুলিশ। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে ওই বিচারকের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ উত্তেজিত হয়ে তাঁর গায়ে হাত তোলে। লাঞ্ছনার শিকার এই বিচারক হলেন নরসিংদীর যুগ্ম জেলা দায়রা জজ-২ মো. ইমান আলী শেখ।


গতকাল রবিবার সকাল সোয়া ৯টায় জেলা আদালতের প্রবেশ মুখে এ ঘটনা ঘটে।
আদালতপাড়ার লোকজন এই ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায়। দিনভর সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করে। ঘটনার পর পুলিশের তিন সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে ওই তিনজনের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছেন জেলা পুলিশ সুপার।
বিচারক, আইনজীবী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল নরসিংদী জেলা আদালতে পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার হাজিরা ছিল। এ জন্য আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়, মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে আদালতের মূল ফটকে পুলিশ সবাইকে তল্লাশি করে প্রবেশ করায়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে যুগ্ম জেলা দায়রা জজ মো. ইমান আলী শেখ রিকশায় করে আদালতের মূল ফটকের সামনে আসেন। আদালতের ভেতরে রিকশা ঢুকতে না দেওয়ায় তিনি সাব-গেট দিয়ে হেঁটে প্রবেশ করতেই তাঁর হাতে থাকা ব্যাগটি তল্লাশি করতে চায় এক পুলিশ সদস্য। এ সময় তিনি নিজেকে বিচারক হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু পুলিশ পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে ইতস্ততভাব দেখিয়ে তিনি আবারও নিজের পরিচয় দেন। কিন্তু ওই পুলিশ সদস্য পরিচয়পত্র দেখা ছাড়া প্রবেশ করতে না দিতে অনড় থাকায় বিচারক বাধ্য হয়ে পরিচয়পত্র বের করতেই অন্য পুলিশ এসে 'তর্ক হচ্ছে কেন' বলে বিচারককে হেলমেট দিয়ে আঘাত করে। এ সময় প্রথম পুলিশ সদস্যও বিচারকের গায়ে হাত তোলে। বিশৃঙ্খলা দেখে নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ এগিয়ে আসেন। তিনি বিচারকের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাঁকে আদালতে প্রবেশের পথ করে দেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী-সহকারী জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, 'স্যারকে (বিচারক) কিছু বলার সুযোগ দেয়নি পুলিশ। তার আগেই পুলিশ বেপরোয়া হয়ে স্যারের শরীরে হাত তুলেছে। পুলিশের এই আচরণে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ি।'
লাঞ্ছনার শিকার বিচারক মো. ইমান আলী শেখ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি তিনবার নিজের পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু পুলিশ আমার কথা শুনতে চায়নি।'
বিচারককে মারার খবর ছড়িয়ে পড়লে আদালতপাড়ায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এ বি এম জহিরুল গনি চৌধুরীর অফিস কক্ষে জরুরি সভা করা হয়। সভায় আদালতের সব বিচারক, আইনজীবী সমিতির নেতা, পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) রুহুল আমীন উপস্থিত ছিলেন। সভায় লাঞ্ছনার শিকার বিচারক ঘটনার বর্ণনা দেন। সভায় উপস্থিত সবাই পুলিশ সুপারের কাছে এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। পুলিশ সুপার এ ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়েছে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
পাশাপাশি সারা দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বিকেল ৫টায় পুনরায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের অফিস কক্ষে সভায় বসেন আদালতের বিচারক ও পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। সভায় ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মোখলেছুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পুলিশ সুপার (শিল্পাঞ্চল) আলমগীর হোসেন ও সহকারী কমিশনার তাসলিমা আক্তার। কমিটি আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
বিচারক ইমান আলী শেখ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই ঘটনাটি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও দেখছে। তারা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তার জন্য আমি অপেক্ষা করছি।'
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রত্যাহার করা তিন পুলিশের একজন নায়েক ও দুজন কনস্টেবল। তবে তাদের পরিচয় জানাতে পারেননি জেলা পুলিশের কোনো কর্মকর্তা।
নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, 'পুলিশ ওনার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। প্রথমে বিচারক খারাপ আচরণ করলে পুলিশ এর উত্তর দিয়েছে। যখন বাগ্‌বিতণ্ডা তুঙ্গে, তখন তিনি নিজের পরিচয় দেন এবং ওই কনস্টেবলকে ধমক দিয়ে গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হন। তা দেখে সহকর্মীরা এগিয়ে আসে। এতে ওনার হাত হেলমেটে লাগে।'
মামুনুর রশিদ আরো বলেন, 'ঘটনার সময় বিচারক খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ নয় বরং বিচারক এর মাধ্যমে সরকারি কাজে বাধা দিয়েছেন।'
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাছেদ ভুঁইয়া বলেন, 'আমরা এই ঘটনায় ব্যথিত, দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ। একজন সাধারণ কনস্টেবলের দ্বারা যদি বিচারক লাঞ্ছিত হন, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। আমরা পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করছি। পুলিশ যদি দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে আইনজীবীরা এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামবেন।'
আইনজীবী সমিতির সভাপতি আরো বলেন, জেলা আদালতের গেটে দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই ছিল পুলিশ লাইনের রিজার্ভ ফোর্স। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করার বিষয়টি অনেকটা লোক দেখানো।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) সুব্রত হালদার সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টির সমঝোতা হয়েছে দাবি করে বলেন, 'এটি ছিল নিছক ভুল বোঝাবুঝি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। ইতিমধ্যে ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।'
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এ বি এম জহিরুল গনি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই ঘটনায় পুলিশ কী ব্যবস্থা নেয়, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করছি। তারপর আমরা করণীয় ঠিক করব।'
জহিরুল গনি চৌধুরী বলেন, 'পুলিশ যদি দাবি করে থাকে এটা তাদের ভুল হয়েছে, এবং এই বিষয়ে আমাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, তাহলে তাদের বলতে বলুন, ভুলটা কী, সমঝোতাটা কী? কারণ এই প্রশ্নের উত্তর সবাই জানতে চায়।'

No comments

Powered by Blogger.