সপ্তাহের হালচাল-একটি শীর্ষ বৈঠক আশা করা কি দুরাশা হবে by আব্দুল কাইয়ুম

প্রবাদ বলে, দুর্যোগের সময় এমনকি বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খায়। এই প্রবাদ রাজনীতিতে কতটা খাটে, বলা মুশকিল। আমাদের দেশের রাজনীতি এত বেশি দ্বন্দ্বমুখর যে জাতীয় দুর্যোগেও নেতা-নেত্রীরা মিলেমিশে কাজ করার প্রশ্নে নির্বিকার থাকেন। এ রকম মনোভাব যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে।


তবে এবার একটু অন্য রকম দেখা গেল। ঈদের আগের রাতে মৃদু ভূমিকম্পের পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাই মিলে দেশ গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় দেশে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সরকারকে সবার সঙ্গে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের এই নমনীয় মনোভাবের অংশবিশেষও যদি দৈনন্দিন রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়, তাহলেও দেশের এক বিরাট অগ্রগতি সাধিত হবে।
ঈদের আগের রাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিরাট এলাকায় যে ভূমিকম্প হয়েছিল তা স্বল্পমাত্রার ছিল বলে তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু তীব্র ঝাঁকুনিতে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঢাকার বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের অনেকে ভয়ে আর ওপরে যাননি, নিচের গ্যারেজে বা অন্য কোথাও রাতটুকু কাটিয়েছে। ভূমিকম্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহদী আহম্মদ আনসারীও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেন, চার দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, তবে এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকার মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে, সম্ভবত মতলবের দিকে হওয়ায় ধাক্কাটা বেশি খেতে হয়েছে। তাঁদের মতে, এটা হয়তো স্থানীয় কোনো ফল্ট থেকে হয়েছে। আবারও যে হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
দেশ নানা বিপদ-আপদের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খরা-ঘূর্ণিঝড় তো লেগেই আছে। জলবায়ু বিপর্যয় আরেক বিপদ। ভূমিকম্পের বিপৎসংকেত প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের মুখে উচ্চারিত হয়। তাঁদের মতে, ১৭৬২ সালে এই অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তারপর আড়াই শ বছর হতে চলল। ১৮৯৭ সালে যে আট দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পে আসাম ও চারপাশের এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, তারপর ১১০ বছর পার হয়ে গেছে। সুতরাং আরেকটা ভূমিকম্প আসন্ন বলে অনেকে মনে করেন। অবশ্য কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, ১০০-২০০ বছরের পুনরাবৃত্তির কথাটা সুনিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারেন না। তার পরও কি নিশ্চিন্ত মনে থাকা যায়?
যদি সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ঢাকার চার ভাগের এক ভাগ ঘরবাড়ি ভেঙে পড়তে পারে। প্রথম ধাক্কায় লোক মারা যাবে হয়তো এক-দেড় লাখ। অবস্থা হাইতির চেয়ে ভালো কিছু হবে না হয়তো। তাহলে এই বিপর্যয়ের আশঙ্কা ধরে নিয়ে সরকারের উচিত আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া। বিপদ যদি সত্যিই আসে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি যেন ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা যায়। কিন্তু শুধু কিছু প্রশাসনিক ও কারিগরি পদক্ষেপই কি এ ধরনের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট? অনেক যন্ত্রপাতি কিনতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তি লাগবে, ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি কীভাবে ভূমিকম্প-সহনীয় করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর পরও কিন্তু দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লাগবে। এটা অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্য দুটি পাশাপাশি স্থাপন করে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। সবাই মিলে দেশ গড়তে হলে প্রথমে দরকার বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করা। সংসদে তাদের আসন কম। কিন্তু মিলেমিশে কিছু করতে হলে তো তাদের বাইরে রাখা যাবে না। সংসদে তারা যায় না। এটা কি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সাংসদসমৃদ্ধ মহাজোট সরকারের জন্য গৌরবের কিছু?
আওয়ামী লীগ হয়তো বলবে, বিএনপি সামনের সারিতে বেশি আসন চেয়েছিল, দিয়েছি, আর কত? কিন্তু এখন তারা চাইছে বিরোধী দল হিসেবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা। সংসদে তারা বেশি কথা বলবে, সরকারি দলকে তুলাধুনা করবে, এটুকু কেন সহ্য করার মনোভাব সরকারি দলের থাকবে না? বিএনপির সাংসদেরা না হয় আক্রমণাত্মক ভাষায় কিছু বললেন। সংসদ অধিবেশনে এ রকম কিছু হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সরকারদলীয় সাংসদেরা যদি মার মার কাট কাট করে তেড়ে আসেন, তাহলে বিরোধী দলের স্বল্পসংখ্যক সাংসদকে অধিবেশনে ধরে রাখা যাবে কি?
ঈদের দুই দিন আগে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে নবনির্মিত শাহ আমানত সেতু উদ্বোধন করলেন। সে সময় বিএনপি অভিযোগ করল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নামাঙ্কিত ভিত্তিপ্রস্তরটি নাকি ভেঙে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ, সেই সেতু তৈরির শুরুর সময় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খালেদা জিয়া, তাঁর সেই নাম-নিশানা মুছে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুবই ছোট ব্যাপার। কিন্তু তাও বুঝতে হবে যে এটা বিরোধী দলের মর্যাদার প্রশ্ন।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও সে সময়ে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিগুলো ভেঙেচুরে ফেলেছিল। এমনকি রাস্তার দুই পাশে বঙ্গবন্ধু সেতুর দূরত্ব নির্দেশক মাইলফলকগুলো থেকেও ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দগুলো ঘষে ঘষে তুলে ফেলা হয়েছিল। বেশ কষ্টসাধ্য কাজগুলো নিশ্চয়ই করেছিলেন তৎকালীন বিএনপির অতি উৎসাহী কর্মীরা। তখন সবাই ওই সব কাজের নিন্দা করেছেন। আওয়ামী লীগও প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু তারাই আবার ক্ষমতায় এসে একই কাজ করে চলেছে। বিএনপির জন্য যে কাজ নিন্দনীয়, আওয়ামী লীগের জন্য সেই একই কাজ কি প্রশংসনীয় হওয়ার কোনো কারণ আছে? এ রকম অনেক ছোটখাটো ব্যাপার সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শুধু মুখের কথায় বিরোধী দলের মন ভিজবে না। কাজে দেখাতে হবে। আওয়ামী লীগ নিজের ঘর সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করছে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিজেরা মারামারি করে নিজদলীয় কর্মীদের মেরে ফেলছে। ওরা নাকি অন্য দলের লোক, গোপনে ঢুকে পড়েছে। তাহলে এত সহজেই কি বিপক্ষ দলের লোকজন সরকারি দলে ঢুকে পড়তে পারে? যা হোক, গ্রেপ্তারট্রেপ্তার করে ও শাস্তিটাস্তি দিয়ে এখন ছাত্রলীগকে কিছুটা বাগে আনা গেছে। কিন্তু কাঁচাপয়সার লোভ কি এত সহজে বশ মানবে?
নিজের দল সামলাতে না পারলে দেশ সামলানো কঠিন। বিরোধী দলকে দাবড়িয়ে নিজের দলকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বরং আওয়ামী লীগ যদি দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেয়, তাহলে বিরোধী দলের আস্থা যেমন অর্জন করা যাবে, তেমনি নিজের দলকেও শৃঙ্খলায় রাখা সম্ভব হবে। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ যে দেশে সুস্থ রাজনীতি ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিল, তা কি তারা ভুলে বসেছে? দিনবদলের সনদের ৫.৪ অনুচ্ছেদে তারা বলেছিল, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’ এই লক্ষ্যে কর্মসূচিও তারা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে। পরিশিষ্ট অংশের চার অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, স্বচ্ছ অর্থায়ন, শিষ্টাচার ও সহনশীল আচরণ প্রতিষ্ঠা করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা ও অধিকতর সংস্কারের লক্ষ্যে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার যে কথা বলেছেন তা করতে হলে তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগই যথেষ্ট। আপনি আচরি ধর্ম বলে একটা কথা আছে। বিরোধী দলকে একটু বেশি মর্যাদা দিলে সরকারি দলের মর্যাদা বিন্দুমাত্র কমবে না, বরং বহুগুণে বেড়ে যাবে। বিরোধী দলের সঙ্গে কার্যকর রাজনৈতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ তাদেরই ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। সংসদে দুই পক্ষের হুইপ পর্যায়ে আলোচনা এখনই শুরু করা দরকার। স্পিকার এ উদ্যোগ নিতে পারেন। পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উচ্চতর নেতৃত্বের স্তরে আলোচনা যাবে।
আলোচনার এই ধারা শীর্ষ দুই নেত্রীর পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, না হলে এর কোনো বাস্তব মূল্য থাকবে না। সেটা আদৌ সম্ভব কি না, তা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারাই বলে দেবে। অতীতে কখনো দুই নেত্রীর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা হয়নি, যদিও এর প্রয়োজনীয়তা দেশবাসী সব সময়ই অনুভব করেছে। অতীতে হয়নি বলে ভবিষ্যতেও হবে না, তা কে বলবে? অন্তত ‘ডিজিটাল শীর্ষ বৈঠক’ তো খুবই সম্ভব। একটু কথা, একটু মতবিনিময় রাজনৈতিক ঝোড়ো হাওয়াকে স্তিমিত করতে পারে।
এ রকম চিন্তার ভিত্তি হলো বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আহ্বান। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সবাইকে নিয়ে বসুন। অবশ্য তিনি যদি তাঁর দল নিয়ে সংসদে যান তাহলেই তো বসা হলো। সেটা তিনি করছেন না কেন? বসার জন্য সংসদের চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে? বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে চায়। এ জন্য শুধু রাজপথ কেন, সংসদ অধিবেশনও তো তাদের কথা দেশবাসীর কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি অতি উত্তম মাধ্যম। এই সুযোগ তারা অবহেলা করছে কেন? যত দূর জানা যায়, বিএনপির সাংসদদের অনেকে অধিবেশনে যেতে চান। বিএনপির এখন এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আপনারা সংসদে যান, খোলামেলা কথা বলেন। তবে এ ক্ষেত্রেও সরকারি পক্ষকে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.