যুক্তি তর্ক গল্প-রাজনীতির লক্ষ্য কি ক্ষমতা, না জনসেবা? by আবুল মোমেন

ক্ষমতা মানুষের সেবা করার সুযোগ বাড়িয়ে দেয়—কথাটায় সত্যতা থাকলেও, দিনে দিনে বোঝা যাচ্ছে, নিছক ক্ষমতা মানুষকে সেবাপরায়ণ করে না। সেবার মনোভাবটাই মুখ্য, এ থেকেই মানুষের মধ্যে সেবা করার প্রণোদনাটা আসে। বলা যায়, ক্ষমতা নয়, মমতাই মানবসেবার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে।


তবে এ কথাও ঠিক, বড় আকারে ও সংগঠিতরূপে মানুষের সেবা করতে চাইলে কিছু অর্থ ও কিছু ক্ষমতার প্রয়োজন বৈকি। এখনো আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনের প্রার্থী ভোটারদের কাছে সেবা করার সুযোগ দেওয়ার আবেদনই জানান। ১৯৫৪ সনের ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় থেকে দীর্ঘকাল নির্বাচনী প্রার্থীদের আবেদনের শেষ বাক্যটি ছিল ‘...ভোট দিয়ে বিজয়ী করে দেশ ও দশের সেবা করিবার সুযোগ দান করুন’। দেশ ও দশের সেবাই ছিল রাজনীতিবিদের মূল কাজ, জীবনের লক্ষ্য। আজকাল সরাসরি এভাবে নিজেকে সেবকের ভূমিকায় প্রকাশ করে আবেদন জানানো হয় না। ভোটারদের হাত-পা ধরা, প্রবীণ ভোটারের হাত ধরে মাথায় ছুঁইয়ে দোয়া নেওয়া হয়; মুখেও নানা প্রতিশ্রুতি ও মিনতির প্রকাশ ঘটতে থাকে। কিন্তু এটা যে অনেকটাই ভোট আদায়ের কৌশল, তা বুঝতে সাধারণ ভোটারের অসুবিধা হয় না। এখন সেই রাজনীতিবিদদেরই প্রাধান্য বেড়ে চলেছে, যাঁদের ব্যক্তিগত জীবন বিত্ত অর্জন ও ক্ষমতাবর্ধনেই ব্যয়িত হয়। তাঁদের যাপিত জীবনে নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনের কোনোই সংযোগ সচরাচর নেই। ভোটটা প্রয়োজন দেশ ও দশের সেবা করার জন্য নয়, সেটা উপলক্ষ; আসল লক্ষ্য নিজের বিত্ত ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তি বাড়ানো। দিনে দিনে এই প্রবণতাটাই বেড়ে চলেছে, এ কারণেই অনেকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একেবারে দক্ষিণের এক সাংসদের অভ্যাস ছিল তাঁর এলাকার নানা শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর করা। এটা তাঁর শাসন করার পদ্ধতি। বিস্তর লেখালেখির পর মারধর কিছুটা প্রশমিত হলেও এলাকায় সর্বপ্রকার কাজে খবরদারি, অর্থাৎ হস্তক্ষেপ করার অভ্যাস বেড়েছে; যেন ধূমপানের অভ্যাস ছেড়ে পান-দোক্তায় আসক্ত হওয়ার মতো ঘটনা।
আওয়ামী লীগের গফরগাঁওয়ের সাংসদ তো দিনদুপুরে রিভলবার উঁচিয়ে নিজ এলাকাবাসীকে শায়েস্তা করার কাজে নেমে পড়েছিলেন। ইদানীং এ রকম মারমুখী সাংসদের সংখ্যা কম নেই। এক প্রভাবশালী সাংসদের চোটপাটের চোটে এক নবীন সাংসদ-মন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে যে জনশ্রুতি প্রচারিত হয়েছে, তাতে সত্যতা আছে বলেই মনে হয়।
এ রকম মারমুখী দাপুটে পৌর চেয়ারম্যান-মেম্বারের খবরও প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার দম্ভ ও প্রতাপ জাহিরের এই প্রবণতা বাংলাদেশে ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
সরকারি আমলা-কর্মকর্তাদের পরিচিতি হলো ইংরেজিতে পাবলিক সার্ভেন্ট, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় জনসেবক। আমলা-কর্মকর্তারা সাধারণত নিজ নিজ পদের ক্ষমতার জোরে ছোট-বড় লাটবাহাদুরের সম্মান নিয়ে ও দাপট দেখিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। মর্যাদা ও দাপট তাঁরা পদাধিকারবলেই ভোগ করতে চান। সম্প্রতি একজন জানাচ্ছিলেন সরকারি অফিসে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বিনা ঘুষে কাজ করাতে চেয়ে ঘোরাঘুরি ও ভোগান্তিতে জেরবার হয়ে একপর্যায়ে তিনি বিভাগীয় কর্তাকে সরাসরি বললেন কাজটা করে দিতে। তাঁর সাহস দেখে কর্তা চটে উঠলে ভদ্রলোক স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তিনি একজন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে চেয়ারে বসেছেন তাঁর মতো প্রার্থীদের সেবা দেওয়ার জন্য। অনভ্যস্ত কানে এ কথা যাওয়ায় কর্তাব্যক্তির ক্রোধ চরমে ওঠে এবং তিনি রাগে কাঁপতে শুরু করেন। পাছে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাই প্রার্থী ভদ্রলোক রণে ভঙ্গ দিয়ে তাঁকে ঠান্ডা করে তবে নিস্তার নেন।
সেবা সম্ভবত আমাদের অভিধান থেকে উঠেই যাচ্ছে। প্রশিক্ষণে এসব কথা থাকে বটে কিন্তু ‘এহো বাহ্য’, সেটুকু সবাই বুঝে গেছে। আর তাই এ দেশে মন্ত্রী, সাংসদ, সচিব, চেয়ারম্যান, ছোট-বড় নানা স্তরের রাজনীতিবিদ কর্মকর্তার দেখা মিলবে, যাঁরা মহাক্ষমতাধর এবং কথায় কথায় ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন।
রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার প্রধান উৎস, মূল অবলম্বন। তাই কেবল রাজনীতিবিদই এ দেশে রাজনীতিতে লিপ্ত ও উৎসাহী নন—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, উপাচার্য, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আমলা, কেরানি—মোট কথা, কে নন? এ দেশে আর রাজনীতি মানে সেবা নয়, ক্ষমতা ও বিত্ত। ফলে আমাদের রাজনীতির আলাদা দুটি হাত গজিয়েছে যেন—এ দুটি হলো দুর্নীতি ও দাপট। এদিকে রাজনীতির মস্তিষ্ক ও হূদয় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অথচ এ দুয়ের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে দেশ ও দশের সেবার প্রক্রিয়াটি। কিন্তু এখন দেশ আর দশ হলো রাজনীতির বুলি, তার চাল হয়ে পড়েছে দুর্নীতি আর ফল মিলছে দাপট। ফলে বর্তমানে রাজনীতির মধ্যে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম বিশেষ থাকছে না; বাড়ছে ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, অধৈর্য, লোভ, অনিয়ম ও নৈতিকতার সংকট।
কথাগুলো আশা করি রাজনীতিবিদেরা একা গায়ে টানবেন না। আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, যেহেতু ক্ষমতা বাগানো ও হাঁকানোর অবলম্বন হয়ে পড়েছে, রাজনীতি তাই এ দেশের সর্বস্তরের উচ্চাভিলাষী মানুষ—সে জেনারেল (অব.), অ্যাটর্নি, বিচারক, সাংবাদিক, উপাচার্য যে-ই হোন, নাম লেখাচ্ছেন রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দলে। সবাই মিলে রাজনীতিকে নীতি ও মূল্যবোধের সংকটে ফেলে দিয়েছেন। যাঁরা নীতি-মূল্যবোধ ধরে রাখতে চান, এ রাজনীতি তাঁদের কনুইয়ের গুঁতোয় পেছনে ফেলে অকার্যকর করে রাখছে।
তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পরে, ঠিক গতবারের মতোই, আওয়ামী লীগের লোকজনের দিক থেকে অস্থিরতা-অধৈর্য আর দুর্নীতি-দাপট যেন বাড়ছে। এই দাপটে তাঁরা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যেমন অপমান-অসম্মানিত করতে চান, তেমনি কানকথায় ভর করে এবারে লেগেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগের পার্থক্য অনেক। বঙ্গবন্ধু গুণী ও মানী লোকদের সম্মান জানাতেন। তাঁর সহযোগী-অনুসারীরাও তা-ই করতেন। তাঁর রাজনীতির সমর্থক না হলেও বর্ষীয়ান সাংবাদিক নির্মল সেনকে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্বোধন করতেন। তাঁর কোনো কোনো কাজের সমালোচনা করা সত্ত্বেও আমার বাবাকে (কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল) তিনি বরাবর শ্রদ্ধা করে এসেছেন। বাকশাল গঠনের পরে বাবা তাতে যোগ দিতে না চাইলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, এ বিষয়ে আপনি নিজের সিদ্ধান্তেই চলবেন, কোনো রকম জোরাজুরি নেই। কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ঠিক সরাসরি আওয়ামী লীগ করা বা বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করায় অভ্যস্ত ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের সম্মানের আসনেই তিনি রেখেছিলেন।
আজকে দেশের মানী লোকেরা একশ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে অসম্মানিত হচ্ছেন, যা নিচের পর্যায়েও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধাচর্চাকে উৎসাহিত করে তুলছে। এটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য খারাপ বৈ ভালো করবে না।
অসহিষ্ণুতা-অশ্রদ্ধার বিপজ্জনক খেলা এখন সংসদ ও সর্বোচ্চ আদালত, সাংসদ ও বিচারকদের সাংঘর্ষিক অবস্থানে নিয়ে গেছে। রাজনীতিতে সংঘর্ষের বাস্তবতা তো রয়েছেই। সবটা মিলে সমাজে অসহিষ্ণুতা ও অশ্রদ্ধার চর্চা বাড়লে রাজনীতির গুণমান আরও নিচে নামবে, গণতন্ত্রের সংকট বাড়বে, দেশ গভীর থেকে গভীরতর সংকটে পড়বে। সেটিই দূরদর্শী নেতৃত্ব, যা দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করে ন্যায় ও সুনীতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারে।
এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই নেতৃত্বেরই আকাল, আর তাই সেই নেতৃত্বেরই প্রয়োজন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.