বৈষম্য-পোশাক নির্বাচনে নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা by জোবাইদা নাসরীন

বাংলাদেশের হাইকোর্ট গত ২২ আগস্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কোনো দপ্তরে নারীদের বোরকা পরতে বাধ্য না করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নারীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত না রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়।


শুধু তাই নয়, এ ধরনের বাধ্যবাধকতা কেন অবৈধ নয়, তা জানতে চেয়ে শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এই রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের ওই নির্দেশ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, পোশাক নির্বাচন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। এ বিষয়ে জোর করা কিংবা বাধ্য করা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এ ধরনের একটি নির্দেশনার ফলে পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার পথে।
ব্যক্তি তার স্বাচ্ছন্দ্য অনুসারে পোশাক পরবে, সেটি নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। সেখানে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন থাকতে পারে না। এই স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে কোনো ধরনের পোশাকের বিরুদ্ধাচরণ নয়, বরং ব্যক্তি সেই পোশাকের সঙ্গে কোন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তির ইচ্ছার বিপরীতে কোনো পোশাক চাপিয়ে দিয়ে তাকে সেটি পরতে বাধ্য করলে তা অবশ্যই তার অধিকারের লঙ্ঘন এবং এটি মানবতার বিপরীতে অপরাধ। কিন্তু পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে এই অপরাধপ্রবণতা লক্ষণীয়। পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে অনেক ক্ষেত্রে নারীকে তার স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে বোরকা, হেজাব, স্কার্ফ কিংবা শাড়ির ওপরে বাড়তি ওড়না জড়ানোর জন্য নানাভাবে বাধ্য করা হয়। নারী কী পোশাক পরবে আর কী পরবে না, সেটি তার ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়।
নারীকে অনেকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার একটি পথ হলো পোশাক। সাম্প্র্রতিক সময়ে নাটোরের সরকারি রানী ভবানী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছাত্রীদের বোরকা ও মার্কিন সাদা কাপড়ের স্কার্ফ পরে আসার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অমান্যকারীকে কলেজ গেট থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হাইকোর্ট এই যুগান্তকারী নির্দেশনাটি দেন। তবে এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টে বোরকার কথা বলা হলেও আমরা দেখি, আমাদের দেশে শুধু বোরকা পরিধানই নয়, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোট ছোট নারী ও শিশুদের পর্যন্ত মাথায় স্কার্ফ কিংবা হেজাব পরতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য করে। ধর্মীয় মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে এ ধরনের ইউনিফর্ম তৈরি করার কথা বলা হয়। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রের ইউনিফর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষিত অসাম্প্র্রদায়িক চরিত্রের বিপরীত। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে আছে, কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, লিঙ্গ কিংবা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য দেখাতে পারবে না। কিন্তু নারীর জন্য বাধ্যতামূলক এ ধরনের ইউনিফর্ম নিঃসন্দেহে কোনো কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতমূলক। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ও বর্ণের (Caste) শিক্ষার্থী আছে। যখন এটি বাধ্যতামূলক করা হয়, এর মানে হয় যে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বাইরে যেসব শিক্ষার্থী আছে, তারাও একই ইউনিফর্ম পরতে বাধ্য থাকবে। এ ধরনের ইউনিফর্ম পরতে বাধ্য করানোর পেছনে প্রকারান্তরে ভিন্ন ধর্মের অস্তিত্বকে অস্বীকারের প্রবণতা কাজ করে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের একধরনের মৌন সমর্থন আমরা অনেক সময় দেখতে পাই। কেননা রাষ্ট্র এ ধরনের বিষয়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে কিংবা এর বিপরীতে অবস্থান নেওয়া থেকে দূরে থেকেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বাধ্যবাধকতা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন লাভ করে। তবে আশা করা যায়, হাইকোর্টের এ নির্দেশনা এ বিষয়ে রাষ্ট্রের দোনোমনা ভাব কাটাতে সহায়তা করবে।
নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে নারীকে বিরত রাখার কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যাবে না বলেও হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তিকে তার মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় বিভাজন টেনে বাধা দিলে সংবিধানের ৩২ নম্বর ধারা লঙ্ঘনের দায়ে অপরাধী হয়। ব্যক্তি কোন ক্ষেত্রে তার মেধার বিকাশ ঘটাবে, সেটি একেবারেই তার এখতিয়ারভুক্ত। যদিও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীকে এ ধরনের মেধা বিকাশে বাধা দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়, অনেক সময়ই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নারীকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহিত করা হয়। যে কারণে খেলাধুলা হয়ে ওঠে শুধুই ‘পুরুষের জগৎ’। কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরচর্চা ও বিনোদন এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ড হিসেবেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্কুলগুলোয় বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন।
বোরকা, হিজাব, স্কার্ফ পরা কিংবা না পরা নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতারই অংশ, এটির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা চলবে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক একমাত্র নারী। সেই সঙ্গে বাধাহীন রাখতে হবে নারীর মেধা বিকাশের সমস্ত পথ। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সদর্প অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছিন্ন হবে লিঙ্গীয় বৈষম্যের আরোপিত জাল। এ বিষয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একই পাটাতনে দাঁড়াতে হবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreeny@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.