ইলিয়াস নিখোঁজ রহস্য-'এখনো মনে হয় তিনি ফিরবেন' by এস এম আজাদ

জায়নামাজে বসে কোরআন তিলাওয়াত আর তসবি জপে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটছে তাঁর। বিষণ্ন, রুগ্ণ চেহারা। উদাস দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজে ফিরছেন তিনি। চোখের কোণে কালো রেখা যেন ঘুমহীন রাতের কাব্য রচনা করে চলেছে। অজান্তেই তাঁর চোখ বেয়ে ঝরছে জলধারা। মুখ লুকান তিনি শঙ্কায়- ছেলেমেয়েরা যদি দেখে ফেলে!
এমনই বিষণ্ন-বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখা গেল বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে নানা শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, সংশয়, অনিশ্চয়তা, ভয়, সন্দেহ আর দুর্বিষহ যন্ত্রণায় দিন কাটছে তাঁর। এসবের মধ্যেই এক মাস ২৪ দিন পেরিয়ে গেছে- এখনো স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় আছেন লুনা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে লুনা বলেন, 'আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন। মাঝে-মধ্যে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে উদ্ধারে সময় নিচ্ছেন। এখনো মনে হয় আমার, তিনি ফিরে আসবেন...।' তারপরই ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, 'এ ঘটনার কোনো তদন্তই হয়নি। উল্টো পুলিশ-র‌্যাব আমাকে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে।' নিখোঁজ হওয়ার পর দলীয় নেতা-কর্মী, আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী আর গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় লেগেই ছিল ইলিয়াস আলীর বনানীর ২/১ নম্বর রোডের 'সিলেট হাউসে'। এখন সেখানে সুনসান নীরবতা। কেউ আর আগের মতো খোঁজ রাখছেন না ইলিয়াস আলীর পরিবারের। কর্তার শূন্যতা বাড়িজুড়ে।
গতকাল রবিবার সকালে সিলেট হাউসে গিয়ে দেখা গেল, ইলিয়াস আলীর তিন ছেলেমেয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে। লুনা জানান, ওরা এখন বেড়াতে যায় না। খেলে না। বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস অর্ণবের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কথা ছিল, লন্ডনে চাচার বাসায় বেড়াতে যাবে সে। দেশের বাইরে তো দূরের কথা, বাসার বাইরেই তার পা পড়ছে এখন।
লুনা বলেন, 'ওদের আমি কিছু বলতে পারি না। ওদের দিকে তাকাতে পারি না। ওরাও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না'- বলেই কেঁদে ওঠেন তিনি।
সাত বছরের সাইয়ারা নাওয়াল ইলিয়াস আলীর একমাত্র মেয়ে। বাবার কথা জানতে চাইলে সাইয়ারা বলে, 'কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। জানি না। আসবে বলেছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন।' অর্ণব এবার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট ছেলে লাবিব শারার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণীতে পড়ে।
কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে ইলিয়াস আলীর ছেলেমেয়েরা বলে, 'বাবার কী হয়েছে, তিনি কোথায় আছেন- না জানার কারণে অস্থিরতায় সময় কাটছে। কেউ কিছু বলতে পারছে না। এত দিন তোড়জোড় থাকলেও এখন সব যেন কেমন চুপসে গেছে।'
সিলেট হাউসের প্রবেশপথে চারটি সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং চলছে। ফটকের পাশের একটি কক্ষে মনিটর বসানো হয়েছে। বনানী থানা-পুলিশের সদস্য শাহ আলম জানান, একজন পুলিশ সব সময় সেখানে থাকেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাহসিনা রুশদীর লুনা কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। কিছু সময় পর কোরআন তিলাওয়াত শেষে তিনি কথা বলেন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। ইলিয়াস আলীর প্রসঙ্গ তুলতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, 'কেউ কোনো খোঁজ দিচ্ছে না। যে-ই অপহরণ করুক, গুম করুক; আমরা তা জানতে চাই।'
লুনা বলেন, 'ডিবি আর র‌্যাব আমার কাছে জানতে চেয়েছে, আমি কাউকে সন্দেহ করি কি না। কারো সঙ্গে শত্রুতা আছে কি না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আছে কি না। আমি ঘরে বসে এসব তথ্য কিভাবে দিব? তারাই বের করুক। তদন্ত করুক।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আশায় বুক বেঁধে আছি। প্রায় দুই মাস হয়ে গেল, কোনো খোঁজ নেই। আমি কারো সঙ্গে কথাও বলতে পারছি না।' শেষ দেখার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'ওই দিন (১৭ এপ্রিল) রাত ১০টায় ছোট ছেলে লাবিবকে নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছ থেকে আসি। তিনি জানতে চান, ডাক্তার কী বলল? একটু কথা হলো। এরপর আমি ওপরে চলে যাই। এমন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ যদি নিখোঁজ হয়ে যান, তবে মনকে কিভাবে সান্ত্বনা দেব?'
ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক ও ব্যক্তিগত সহকারী আনসারের প্রসঙ্গ তুলে লুনা বলেন, 'ওর পরিবারের অবস্থা খারাপ। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি নেই।' আগের মতো কেউ তাঁদের খোঁজ রাখছে না জানিয়ে তিনি বলেন, 'সবাই এখন যার যার কাজে ব্যস্ত। একটা বিষয় কে কত দিন মনে রাখে বলেন?'
বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর পর লোকজনের আসা-যাওয়া কমে গেছে দাবি করে লুনা বলেন, 'আমার বাসায় আসে পরিচিতজন, আত্মীয়রা। তাঁদের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করে কী লাভ? গুলশানের ডিসি বলেন, নিরাপত্তার জন্যই নাকি এ সিসিটিভি। অনেকে ঝামেলা এড়াতে এখন বাসায় আসবে না।'
ঘটনার তদন্তই হয়নি!
তদন্তের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে লুনা বলেন, 'আসলে এ ঘটনার কোনো তদন্তই হয়নি। পুলিশ এখনো বের করতে পারেনি, কোন এলাকা থেকে তিনি নিখোঁজ হলেন? গাড়িটি কেমন করে রাস্তার পাশে পড়ে ছিল? এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না।' তিনি জানান, এসব ব্যাপারে পুলিশ একেক সময় একেক কথা বলেছে। একবার বলেছে, টহল পুলিশ গাড়িটি উদ্ধার করেছে। একবার বলেছে, রাস্তায় যানজট লাগার পর গাড়িটি উদ্ধার করে থানা-পুলিশ। একবার বলেছে, কেউ একজন থানায় ফোন করে গাড়িটির পড়ে থাকার খবর দেয়।... ইলিয়াস কোন এলাকা থেকে নিখোঁজ হলেন তাঁর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন লুনা। ওই ডায়েরির ভিত্তিতে তদন্ত করছেন বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাইনুল ইসলাম। নিখোঁজ হওয়া ও প্রাইভেট কার উদ্ধারের ব্যাপারে তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বনানীর ২ নম্বর রোড থেকেই গাড়িটি উদ্ধার করা হয়। কোন এলাকা থেকে তিনি নিখোঁজ হলেন তা জানতে তদন্ত চলছে।'
একেক সময় একেক রকম তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মাইনুল ইসলাম বলেন, 'এ ঘটনার তদন্তের ব্যাপারে ১০ দিন পরপর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। তাই এ ব্যাপারে নতুনভাবে কিছু বলা যাবে না।'
প্রসঙ্গত, গত ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর মহাখালী এলাকা থেকে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর থেকে ইলিয়াস ও তাঁর গাড়িচালক আনসারকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিয়াসকে গুম করা হয়েছে অভিযোগ করে দুই দফায় পাঁচ দিন সারা দেশে হরতাল করে বিএনপি। ওই সময় তাহসিনা রুশদীর লুনা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। প্রধানমন্ত্রী তাঁর অনুরোধে সাড়া দিলে গত ২ মে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গণভবনে যান লুনা। গত ৯ মে সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলন করে লুনা তাঁর স্বামী উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.