এসো নীপবনে-ঈদ মোবারক by আবুল হায়াত

দ্বারপ্রান্তে ঈদ। ঘরমুখো মানুষের ছোটাছুটি। ফাঁকা হচ্ছে ঢাকা শহর। যানজটের অভিশাপ থেকে দিন পনেরোর জন্য মুক্তি পাবে রাজধানীর মানুষ। তার কিছু নমুনা গতকালই পাওয়া গেল—শান্তিনগর থেকে গুলশান ১ নম্বর চত্বরে যেতে সময় লাগল মাত্র আট থেকে ১০ মিনিট। তাও আবার ইফতারের আগে আগে। অতি আশ্চর্য ঘটনা বটে।


এক ঝাঁক টিয়া এসে বসল আমার নীপবন্ধুর মগডালে। আমার নীপবনে, এখন আর শুধু একটা কদমগাছ নেই—রয়েছে চার চারখান গাছ। সামনেই আকীজ সাহেবের ফাঁকা চত্বরের শিশু গাছ কয়টি রীতিমতো যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে। ফুল দিয়েছে এবার সবাই। তাই ফুল ঝরে গিয়ে ফলগুলো এতদিনে পেকেছে। সেই লোভেই টিয়াদের দল বেঁধে আসা। কাকেরাও দেখি ভাগ বসায় টিয়ার খাদ্যে। কিন্তু দুই দল পাখির মধ্যে মারামারি খুনোখুনি নেই। যার যার মতো খায়
একজোড়া টিয়াকে লক্ষ করছিলাম। ওরা অন্যদের থেকে একটু আলাদা থাকতে পছন্দ করছে। একজন অন্য ডালে গেলেই অন্যটিও সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া ফেলে তার কাছে যাচ্ছে মুহূর্তে। ওদের খুব ভাব। আবার দেখি, একটি নতুন ফলে একজন কামড় দিয়ে অন্যটিকে ইশারায় ডাকছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যটি এসে সেই ফলেই দিল এক ঠোকর। তারপর দেখি, ডানা ফুলিয়ে ডানা ঘষাঘষি করছে দুজন। রাগ-অনুরাগের পালা চলছে। আমি যেন দিব্য চোখে দেখলাম, ওদের একজন বলছে: ‘হাতখানি তব রাখ মোর হাতে—’
সত্যিই তো ওদের হাত থাকলে ওরা করত কী? প্রেমিক-প্রেমিকা হাত ধরাধরি করা ছাড়াও যেটা করত বলে আমার মনে ভাসছে, তা হলো দুজন দুটো ফল হাত দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে বলত, ‘চলো, বাড়ি গিয়ে নিভৃতে আলাপ করি।’
নাহ্। হাত নিয়ে হাতাহাতি চলতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে কল্পনাবিলাসী হওয়াটা একটু বেশি হয়ে যায়, তাই না?
তাহলে ফিরে আসি বাস্তবে। এক বিখ্যাত ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার ওয়ার্কস পদে নিয়োগের সাক্ষাৎকারে একটিমাত্র প্রশ্ন সব প্রার্থীকে করা হয়েছিল: ‘হাত দিয়ে আমরা কী করি? সর্বপ্রথম যেটি মনে আসবে, সেই উত্তরটি দেবে।’ উত্তর এসেছে হরেক রকম। হাত দিয়ে খাই, হাত দিয়ে লিখি, হাত দিয়ে সালাম দিই, হাত দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাই, হাত দিয়ে দান করি, হাত দিয়ে গ্রহণ করি, হাত দিয়ে বর্জন করি ইত্যাদি। কিন্তু চাকরি পেল একজন, যে বলেছিল হাত দিয়ে কাজ করি।
হাতওয়ালা মানুষ ভাবতেই পারে না, হাত না থাকলে তার চলত কীভাবে। তবে হাত ছাড়াও চলতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেখেছি জয়পুরহাটের ভাদসা গুচ্ছগ্রামে। গত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রী হালিমা খাতুনের বাবাকে দেখেছি। জন্মগতভাবে দুটো হাতই নেই। কিন্তু তিনি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন। হালিমাকে শিক্ষিত করে তুলেছেন। আমরা দেখি, পা দিয়ে লিখে ট্রান্সলেশন শেখাচ্ছেন তাঁর সন্তানকে। হস্তের অধিকারী অনেক মানুষের জন্যই এটা একটা লজ্জার কারণও বটে।
আসলে হাত যে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তাতে তো সন্দেহের কোনো কারণ নেই। হাত দিয়ে আমরা যেমন খাই, পরি, লিখি, প্রার্থনা করি, বিদায় জানাই, ভিক্ষাও করি, চুরিও করি। আবার এই হাত দিয়ে কখনো আঁজলা ভরে পানি পান করে তৃপ্ত হই, কখনো বা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে মানবতার সেবায় রত হই।
হাত যেমন শরীরকে পূর্ণতা দেয়, তেমনি অদ্ভুতভাবে অলংকৃত করেছে ভাষাকে। আমাদের বাংলা ভাষাতেই দেখুন না হাত নিয়ে কত রকমারি সব ভাবের বহিঃপ্রকাশ। উদাহরণ প্রচুর, হাত দিয়ে হাত সাফাই করি, হাত মাপি (এক হাত, দুই হাত ইত্যাদি), ডান হাতের কাজ করি, হাত ভারী করি, হাতযশ অর্জন করি, হাতে-কলমে কাজ শিখি, বিব্রত হলে হাত কচলাই, রাগলে হাত কামড়াই, বিপদে পড়লে জ্যোতিষীকে দিয়ে হাত গোনাই, ব্যস্ততা থাকলে কাজে হাত চালাই, অপরাধ করলে হাত জোড় করে ক্ষমা চাই, অতি ব্যস্ত হলে বলি আমার হাত জোড়া, শুরুতে কোনো কাজে হাত দিই, হতাশ হয়ে কোনো বিষয় থেকে হাত ধুয়ে ফেলি।
আমার এসব পাণ্ডিত্যে আপনারা হাততালি দেন বা না দেন, আমার কিন্তু হাতেখড়ি হয়েছিল ১৯৪৭-এ গ্রামের মসজিদে। শিরিনের হাত গ্রহণ করেছিলাম ১৯৭০-এর জুলাইয়ে।
এবার একটা গূঢ় কথা বলে দিই। হাতের যতই উপকারিতা থাক না কেন, কখনো কখনো হাত হয়ে দাঁড়ায় একজন অভিনেতার শত্রু। মনের কথা শোনে না, এদিক-ওদিক উল্টাপাল্টা চলতে চায়। অভিনেতা যেন বুঝতেই পারে না হাত কোন জায়গায় কীভাবে রাখবে। এক মহাজ্বালা হয়ে যায় হাত। কেউ পকেটে রাখে, কেউ ঝুলিয়ে রাখে বুক বরাবর, কেউ দুহাত মোচড়ায়, কেউ বা ঘন ঘন গা চুলকায় হাত দিয়ে।
কলকাতার ঘটনা শুনুন। নাট্যজন শচীন ভৌমিকের লেখাতে বহুকাল আগে পড়েছিলাম, রকে বসে আড্ডা মারছিলেন এক নায়ক। তখনো নায়ক হননি তিনি। এক ভিক্ষুক সাত-আটটা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে বলল, ‘বাবা, একটি টাকা দিলে বাচ্চাগুলোর আজ খাওয়া হয়। দিন না বাবা। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন। বাচ্চাগুলো দুদিন অভুক্ত।’
‘দাদা, খেতে পান না তো এত বাচ্চা নিয়েছেন কেন?’ নায়ক ভিক্ষুককে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘কী করব দাদা, সবই ভগবানের হাত।’
হিরো তখন এক রুপি বের করে তাঁকে দিয়ে বললেন, ‘নিন ধরুন। ভগবানের হাতটা কেটে ফেলবেন (বা সামলান)।’
রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ সংগঠন অনেক। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছাত্রসংগঠন। মানুষের হাতের মতোই জরুরি ও কার্যকর। হাতের ভালোমন্দ সবই এতে পরিলক্ষিত। জাতির দুর্যোগে এই হাত জাতিকে উপহার দিয়েছে অনেক মহার্ঘ্য অর্জন।
সেই কৃতজ্ঞতায় কি আমরা সর্বদাই তাঁদের কাছে হাত জোড় করে থাকব, নাকি তাঁদের ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলব, নাকি সৃষ্টিকর্তার কাছে ওই নাট্যজনের মতো কাতর আর্জি জানাব দু-হাত তুলে? ঈদ মোবারক।
আবুল হায়াত: নাট্য ব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.