পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল: আগামী দিনের রাজনীতি

৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল: আগামী দিনের রাজনীতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। তাঁদের আলোচনা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হলো এখানে।


যাঁরা অংশ নিলেন
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, মাননীয় মন্ত্রী
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
সাংসদ ও সভাপতি; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং
কো-চেয়ারপারসন, সংবিধান সংশোধনী সম্পর্কিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ
অর্থনীতিবিদ ও অন্যতম ট্রাস্টি, টিআইবি এবং সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাংসদ এবং সদস্য, সংবিধান সংশোধনী সম্পর্কিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি, জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য
লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান
সাবেক সেনাপ্রধান, বিএনপির স্থায়ী
কমিটির সদস্য
খন্দকার মাহবুব হোসেন
সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি
আমিন আহমেদ চৌধুরী
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল
ড. শাহ্দীন মালিক
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
গৌতম দেওয়ান
সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

মতিউর রহমান
দেশের উচ্চ আদালত সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। এই রায়ের পরবর্তী পরিস্থিতি ও আগামী দিনের রাজনীতি কী হতে পারে, তা-ই আজকের গোলটেবিলের আলোচ্য বিষয়। এ দুটি রায়ের ফলে আমাদের কাছে তিনটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথমত, এ রায়ের ফলে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ ১৯৭২ সালে যে গণতান্ত্রিক সংবিধান পেয়েছিল, সেই বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে ফিরে যাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ কার্যকর সংসদ, জনগণের অংশগ্রহণ মূলক গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা শক্তিশালী করা, অসাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও তাদের তৎপরতা রোধের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে অসাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল, সামরিক আইন জারি প্রভৃতির বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও ব্যবস্থা নেওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। তৃতীয়ত, দুটি রায়ের ফলে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। আমরা বলতে চাই, সাম্প্রদায়িকতা গণতন্ত্রে অচল। আমরা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকতে চাই। একই সঙ্গে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিস্তার আমরা দেখতে চাই না। সর্বোপরি ভবিষ্যতে আমাদের দেশে আর কখনো সামরিক শাসন ফিরে না আসুক, তা-ই আমরা চাই। সে জন্য শুধু সংবিধানের একটি বা কয়েকটি ধারা বা অনুচ্ছেদ যুক্ত বা পরিবর্তন করলেই হবে না। আমরা মনে করি, দেশে একটি স্থিতিশীল আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সংবিধানের ধারা বা বিধান অবশ্যই লাগবে। কিন্তু পাশাপাশি সুস্থ, সহনশীল রাজনীতি, শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমনে কার্যকর ব্যবস্থা, মানবাধিকার নিশ্চিত করা, বিভিন্ন সাম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর অধিকার বাস্তবায়ন—এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়গুলো আগামী দিনের রাজনীতিতে জরুরি ভাবনা-চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে। আমরা পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়কে স্বাগত জানাই। সংবিধান সংশোধনবিষয়ক সংসদীয় বিশেষ কমিটি ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে। কমিটি তিনটি বৈঠক করেছে। তারা তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজকের এ প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। আলোচনার শুরুতে প্রধান অতিথি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী শফিক আহমেদকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল একটি ঐতিহাসিক রায়। আমি প্রথমে পঞ্চম সংশোধনীর বিষয়ে কিছু বলব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। সেই ১৫ আগস্টেই সামরিক শাসন কার্যকর হলেও ২৩ আগস্ট প্রথম সামরিক ফরমানটি জারি করা হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে যে কয়টি সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল, প্রতিটির প্রথম সামরিক ফরমানে বলা হয়, কী কারণে সামরিক শাসন জারি করা হলো। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, ১৯৭৫ সালে যখন সামরিক শাসন জারি করা হয়, তখন কিন্তু কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। যখন ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেওয়া হয়, তখন প্রথমবারের মতো কারণটি ব্যক্ত করা হয়। আরেকটি বিষয়, প্রথমবারের মতো একজন সিভিলিয়ান (বেসামরিক ব্যক্তি) কোনো সামরিক শাসন জারি করেন। পৃথিবীর কোথাও সিভিলিয়ান কেউ সামরিক শাসন জারি করেছেন—এমন উদাহরণ পাওয়া যায়নি। তিনিই (খন্দকার মোশতাক আহমেদ) কিন্তু সামরিক ফরমানগুলো জারি করতে থাকেন। তখন কিন্তু বাংলাদেশের সংসদও ছিল এবং ওই ব্যক্তি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি কিন্তু তাঁর মন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন এবং সাংসদেরাও ছিলেন। তিনি ৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সংবিধানের কোথাও স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান নেই। ৮২ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর তিনি (মোশতাক) বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির (বিচারপতি আবু সাদ'ত মোহাম্মদ সায়েম) হাতে ক্ষমতা তুলে দিলেন। তিনি (সায়েম) নিজে রাষ্ট্রপতি হলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সামরিক কর্তাও হয়ে গেলেন। সে সময় সংবিধানকে চূড়ান্ত অবজ্ঞা ও অবমাননা করা হয়। কারণ, প্রধান বিচারপতি কিংবা বিচারপতি হওয়ার আগে শপথগ্রহণ করতে হয়। শপথে বলেন, তাঁর প্রধান কাজ হবে সংবিধান সমুন্নত রাখা এবং সাংবিধানিকভাবে তিনি বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি আরেকটি নজিরবিহীন ঘটনা, প্রধান বিচারপতি তাঁর শপথ ভঙ্গ করে একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করলেন। তাঁরা তখন মাঝেমধ্যে সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধানকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন।
আমাদের সংবিধান মূল প্রস্তাবনায় দুটি অঙ্গীকার ছিল। প্রথমে ছিল—আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মার্চ মাসের ২৬ তারিখ স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া, জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ, আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ এবং বীর শহীদদের প্রাণ উৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনাবোধ থেকে করা হয়েছিল তা বিবেচনা করিয়া সংবিধান রচনা করা হলো। সেটি তখন সামরিক ফরমান দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছিল—সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস। যেটি ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।
আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে ছিল জাতীয়ভাবে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র আবার সংশোধনীর মাধ্যমে করা হলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার—এসব আদর্শ সংবিধানের মূলনীতি হবে। তাহলে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যে মূল সংবিধান গৃহীত হয়েছিল মহান জাতীয় সংসদে, সেখানে অঙ্গীকারটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। যাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁদের মুখের কথাটি জোর করে তুলে দিয়ে নতুন কথা যোগ করা ঠিক নয়। হয়তো ধর্মীয়ভাবে তাঁরা তার অনুসারী না-ও হতে পারেন। সংবিধানকে এ পরিবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে জোর করে নতুন শব্দ তুলে দেওয়া হলো। রাষ্ট্র পরিচালনার ও আইন করার এবং ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি ছিল, তার ভিত্তিতেই করতে হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বদলে ফেলা হলো। যেখানে বাহাত্তরের সংবিধানে চারটি মূল কাঠামোর অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, সেটি রাখা হলো না। আরও পরিবর্তন করে যেটি করা হয়, সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটি বাতিল করা হয়। সেখানে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র কী করবে বা করবে না, কিন্তু সামরিক ফরমান দিয়ে এই ১২ অনুচ্ছেদটি সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে আমি মনে করি, এই ১২ অনুচ্ছেদটি আবার সংবিধানে ফিরে এসেছে। আরেকটি বিষয় হলো অনুচ্ছেদ ৩৮, সেখানে দল, সমিতি কিংবা সংঘ করার অধিকার সবার থাকবে; কিন্তু সেখানে একটি শর্ত ছিল ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, ধর্মীয় নামযুক্ত কোনো দল, সমিতি কিংবা সংঘ করা যাবে না। সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রোভাইসো বা শর্ত উঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল, তৎকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে অপপ্রচার চালিয়েছিলেন। সেদিন ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ তুলে দেওয়ার ফলে তিনি দেশে ফিরে জামায়াতে ইসলামীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদটিতেও নতুন সংযোজনী আসে। সামরিক ফরমান দিয়ে আনা কতিপয় বেআইনি বিধানাবলিকে বিশেষ রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও সেগুলো পরিবর্তন না করতে পারে। যাতে গণভোট করতে হয়। এই বিধানটিও যুক্ত করা হলো মার্শাল ল প্রকলেমেশন দিয়ে। ১৯৭৯ সালে যখন নির্বাচনে একটি দল দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করল, তখন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীটি পাস করল। সেখানে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত যেদিন মার্শাল ল উঠে যায়, সেদিন পর্যন্ত মার্শাল ল কর্মকর্তা যাঁরা ছিলেন এবং তাঁদের অধীনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যেসব সামরিক ফরমান দিয়েছেন, সবকিছু এবং সংবিধানের যেসব পরিবর্তন করা হয়েছিল এই সময়ের মধ্যে, এসব কিছুরই বৈধতা দেওয়া হলো। এটিই ছিল সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর ধারা। আরও বলা হলো এই যে সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধানের যে পরিবর্তন করা হয়েছে, তা কোনো আদালতেই চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এটিও সংবিধানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
সংবিধানের কোথাও মার্শাল ল-এর কথা উল্লেখ ছিল না এবং সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনা হবে কীভাবে, তা উল্লেখ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ এ সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন্ন রাখা, রক্ষণ, সমর্থন, নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য। আমাদের মানে, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য বলে বোঝানো হয়েছে। আমরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এটি ঘোষণা করে সংবিধান গ্রহণ করেছি। এ দায়িত্বটি আমরা সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি সামরিক শাসনের কারণে। সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ওপর যদি কোনো প্রকার হামলা করা হয় অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে যদি সংশোধন করা না হয়, এমনকি সংসদ যদি করে, সুপ্রিম কোর্টের কিন্তু ক্ষমতা আছে সে বিধান বা সংশোধনকে বাতিল বলে ঘোষণা করার।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় ১৫ জন বিচারপতি রায় দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, সংবিধান সৃষ্টি করেছে সংসদকে। সংসদ কখনো সংবিধানকে ধ্বংস করতে পারবে না। অর্থাৎ সংবিধানের যে মূল কাঠামোগুলো আছে, সেগুলো ধ্বংস করার অধিকার সংসদের নেই। ঠিক তেমনই পঞ্চম সংশোধনী বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। কারও ক্ষমতা নেই সামরিক ফরমান দিয়ে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে অসাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার। সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধানের কোনো রকম পরিবর্তন করার এখতিয়ারের কথা আমাদের সংবিধানে উল্লেখ নেই। তাই উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনীটি বাতিল করেছেন। কারণ, সামরিক শাসকের ক্ষমতাই ছিল না সংবিধান পরিবর্তন এবং অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের।
সুতরাং যেদিন আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় ঘোষণা করেছেন, সেদিন থেকেই যে অনুচ্ছেদগুলো পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়েছিল, সেগুলো পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে ধর্মনিরপেক্ষতা, অনুচ্ছেদ ১২, অনুচ্ছেদ ৩৮-এর প্রোভাইসো এবং অনুচ্ছেদ ১৪২ বাহাত্তরের সংবিধানে আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে যে সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেখানে বাতিল আইনকে বাতিল করার জন্য নতুন করে আর সংশোধনীর প্রয়োজন নেই।
উদাহরণস্বরূপ ১০০ নম্বর অনুচ্ছেদে অষ্টম সংশোধনী পাস হয়েছিল সংসদে, তখন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এরশাদ বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের মূল অফিস ঢাকায় থাকবে, সময়ে সময়ে সার্কিট বেঞ্চ করা যাবে। কিন্তু অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে পারমানেন্ট বেঞ্চ অব হাইকোর্ট করে দিলেন। একটি মামলা আপিল বিভাগে আনোয়ার হোসেনের। সেখানে আপিল বিভাগ বললেন, সংবিধানের ১০০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দিয়ে পারমানেন্ট ব্রাঞ্চ অব হাইকোর্ট করলেন রাজশাহী, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট—এগুলো বাতিল। এই বাতিলের মাধ্যমে আর নতুন করে সংশোধনী আনার প্রয়োজন কিন্তু হয়নি। ধর্মীয় রাজনীতি সম্পর্কে অনুচ্ছেদ ৩৮-এর শর্ত সংবিধানে ফিরে আসার কারণে এখন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বাড়ল। যদি কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সংবিধানের কোনো বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হয় এবং যদি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হয়ে থাকে, তবে তার নিবন্ধন বাতিল করা এবং ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হতে না পারে সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
আইনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। আলোচনার শেষ দিকে আমরা আবার তাঁর কাছে ফিরে আসব। এখন আলোচনার জন্য অনুরোধ করছি আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে।

ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সপ্তম সংশোধনীতে সংবিধানের কোনো ধারার পরিবর্তন করা হয়নি, শুধু সে সময়ে সামরিক শাসনের সময়কাল ও যেসব আইন করা হয়েছিল, সেগুলোর বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। অষ্টম সংশোধনীতে যে সংবিধানের মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়, তার প্রথমটি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা এবং দ্বিতীয়ত পাঁচটি স্থানে জুডিশিয়ারি হাইকোর্টের পারমানেন্ট বেঞ্চ করা। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, আমরা যেদিন উচ্চ আদালতের রায় পেলাম, সেদিন থেকে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেছি। আমাদের সপ্তম সংশোধনী বাতিল রায়ের মাধ্যমে সব সামরিক শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আবার যাতে অসাংবিধানিক উপায়ে সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা দখল করতে না পারেন, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডকট্রিন অব নিসেসিটি বাতিল হয়েছে। এটা ভবিষ্যতে সামরিক শাসন কায়েমের প্রধান বাধা, তবে সে রকম কিছু হবে না, সেটা বলা যায় না।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের চারটি মূল কাঠামোতে ফিরে গেছি। ধর্মনিরপেক্ষতায় আমরা ফিরে গেছি। কিন্তু দ্বন্দ্ব থেকে যাচ্ছে—অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে ইসলাম। যেখানে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকে যাচ্ছে, সেখানে আবার আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছি। স্পষ্টত এখানে একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। আরেকটি বিষয়, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ থাকছে, অনেকের মতামত হচ্ছে, এটি সংবিধানের অংশ নয়। কারণ, এটি শুরুতেই আছে। অনেকে সাধারণ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝাতে চান, ধর্মের কথা বলা হবে না। এই মতের সঙ্গে আমি একমত নই। বাংলাদেশের সংবিধানে এমন কোথাও উল্লেখ নেই যেখানে বিশেষ কোনো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর জন্য আলাদা করে কোনো বিশেষ সুবিধার কথা রয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের সংবিধান একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। যেমন ব্রিটেনে রানি-প্রথা চালু রয়েছে। রানি গির্জার প্রধান। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ। আমাদের দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে নিশ্চিত করা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে কি না। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমি বুঝি, সমাজের সব ধর্মের সবার মধ্যে কোনো বৈষম্য না থাকা। অর্থাৎ সব সাম্প্রদায় ও গোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ অধিকার পাবে। রাষ্ট্রভাষা যেমন বাংলা এবং জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাঙালি, ঠিক তেমনই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম রাখা যেতে পারে। তবে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। অর্থাৎ ধর্মকে যদি রাজনৈতিক পরিচিতি না দিই, তবে আমার মনে হয় ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে, তা আর থাকবে না। আর সমাজতন্ত্রের কথা বলতে গেলে উন্নত বিশ্ব—যেমন ইউরোপ, চীন কিংবা রাশিয়া এগুলো সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতি বিদ্যমান। আর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রশ্নে আমার মত হচ্ছে, তারা যদি ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে, সে ক্ষেত্রে তা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য ধর্মকে যাতে কোনো দল, সংঘ বা অধিসংঘ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা।
ভবিষ্যতে সামরিক শাসন যাতে ফিরে আসতে না পারে সে জন্য সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে, সর্বোপরি জনগণকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। সংঘাতময় রাজনীতি পরিহার করে কার্যকর সংসদ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যত দিন পর্যন্ত পরিবর্তন করতে না পারব, তত দিন সামরিক শাসন ফিরে আসার হুমকি থেকেই যাবে।

আব্দুল কাইয়ুম
ধন্যবাদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে। এখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

খন্দকার মাহবুব হোসেন
চিরন্তন সত্য কথা হচ্ছে, সামরিক ফরমান দ্বারা কখনো সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না। তবে সামরিক ফরমান দিয়ে পঞ্চম সংশোধনীতে যেসব বিধানকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল, তা সবই এখন অবৈধ। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামরিক ফরমান দ্বারা যেসব বিধান করা হয়েছিল, তার কিছু অংশ রাখা হয়েছে, বাকিগুলো অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে একটি দ্বৈতনীতির কারণে আমাদের সামনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তাতে বাহাত্তরের সংবিধানে যা ছিল সেখানে আমরা ফিরে যাব। আমাদের চতুর্থ সংশোধনীতেও ফিরে যেতে হবে। তাহলে আমাদের বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। তাই এ ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয় না। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ হাইকোর্টের রায়ে আপনা-আপনি পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়েছিল। হাইকোর্টের সে রায় এবং পঞ্চম সংশোধনী রায় কিন্তু একই রকম নয়। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সামরিক ফরমানে কিছু অংশ রাখা হয়েছে, কিছু অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সুতরাং আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার আলোকে আমাদের জাতীয় সংসদকে সংবিধানের সংশোধনী করতে হবে। সংবিধান যুগের প্রয়োজনে, জনগণের স্বার্থে পরিবর্তন করা উচিত। বর্তমানে সংবিধান সংশোধনী নিয়ে এমন একটি অগোছালো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সংসদে আলোচনা ছাড়া পূর্ণাঙ্গরূপে ফিরে পাওয়া কষ্টসাধ্য। তাই বর্তমানে যে সংবিধান সংশোধনীবিষয়ক সংসদীয় বিশেষ কমিটি রয়েছে, তাদের উচিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনীর সুপারিশ তৈরি করা। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি সংবিধান সংশোধন করে, তবে ভবিষ্যতে আরেকটি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নতুন করে আরেকটি সংবিধান সংশোধনী করার সম্ভাবনা থেকে যায়। অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণে, সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে অগোছালো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে সংসদে সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে সমাধান করা যায়। যদি সংবিধানে অটো রেস্টোরেশন হয়, তবে আমরা আবার বিতর্কিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হব। যুগের প্রয়োজনে, জনস্বার্থে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, সবার মতামত গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে সংবিধান সংশোধনী করতে হবে সংসদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
সংবিধান সংশোধনী সম্পর্কিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি অল্প কিছুদিন ধরে কাজ শুরু করেছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কমিটি যেদিন যতটুকু কাজ করবে, তা মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরব। আর বিতর্কিত বিষয়গুলো এখনো আমরা আলোচনায় আনিনি। এখন শুধু সামরিক ফরমান দ্বারা যেসব বিধান পঞ্চম সংশোধনীতে করা হয়েছিল, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। আর কোনো বিষয় কমিটিতে এখনো আলোচনা হয়নি। আসলে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের ফলে সংবিধান সংশোধন হাইকোর্টের রায়ে হবে, নাকি তার অনুসরণে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে হবে, সে ব্যাপারে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল যদি অবৈধ হয়, তবে তার অধীনে নির্বাচন ও সংসদ সবই অবৈধ। বর্তমানে সুপ্রিমকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে দিয়েছেন। বিচারপতিরা শপথ নেন সংবিধান সমুন্নত রাখার। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি, যতগুলো সামরিক শাসক এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে কোনো কোনো বিচারপতির সুসম্পর্ক দেখা গেছে। এই প্রথম হাইকোর্ট জনগণের স্বার্থে এই ঐতিহাসিক দুটি রায় দিয়েছেন। সামরিক শাসনামলে ধর্ম আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে আজকের উগ্র জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়েছে।
যখন জনগণ ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন সামরিক শাসন অবৈধ হয়। বর্তমানে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সামরিক শাসকেরা সংসদের ক্ষমতা খর্ব করে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্ন সামরিক ফরমান দিয়েছিলেন। সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছেন হাইকোর্ট। যদি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো কিছু হয়, তবে তা দেখার ও অবৈধ ঘোষণা করার ক্ষমতা হাইকোর্টের। কিন্তু জনস্বার্থে সাংবিধানিক উপায়ে সংবিধানের কোনো পরিবর্তন করার ক্ষমতা শুধু সংসদেরই আছে। যেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংসদকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সামরিক শাসকেরা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে নষ্ট করে দিয়ে গেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিকে ধ্বংস করেছেন। নতুন কোনো সংবিধান তৈরির ক্ষমতা কারও নেই। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুজিবনগর সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। সেই বীর শহীদদের স্মৃতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের জন্য সংবিধান তৈরির অ্যাসেম্বলি হয়েছে। সেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ ধারণ করে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। সেই সংবিধানকে সামরিক শাসকেরা বারবার আঘাত করেছেন। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছিল। বর্তমানে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব কাঠামো ছিল, তাতে আমরা ফিরে গেছি। এখন সংবিধান সংশোধনী কমিটির কাজ হবে বাহাত্তরে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে যেসব বিধান পঞ্চম সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, বা যেগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেগুলো বাদ দেওয়া। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতন্ত্রের কথা বলছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সামাজিকভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমাদের সংঘাতময় রাজনীতি পরিহার করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আগে তারা সামাজিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উচ্চস্তরে উন্নত করে, পরে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ করেছে। কিন্তু আমরা তার বিপরীত পথে চলছি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে আমি কখনো সমঝোতা করতে পারি না। তেমনি অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান পরিবর্তন মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্বায়নের যুগে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে হাইকোর্ট আজকের এই রায় দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর চূড়ান্ত রায় পাওয়ার পর সংসদীয় বিশেষ কমিটি তার আলোকে সংবিধানে পরিবর্তন আনবে। জনগণের ক্ষমতা যাতে ভবিষ্যতে বন্দুকের নল দেখিয়ে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল করতে না পারে, সেজন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে, সে জন্য সব দলের অংশগ্রহণে একমত হয়ে একটি বিধান করতে হবে সংবিধানে। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছি, যারা বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করে এবং বাহাত্তরের সংবিধান অনুসারে। গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই কোনো জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি বিরোধী দলকে আহ্বান করব, সাংবিধানিক উপায়ে এই বিশেষ কমিটিতে অংশগ্রহণ করে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেওয়ার, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার জন্য।

আব্দুল কাইয়ুম
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ধন্যবাদ। তিনি অনেকগুলো বিষয় পরিষ্কার করেছেন। সংসদীয় বিশেষ কমিটিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করে একটি জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমরা আশা করব, বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এখন আলোচনা করছেন সাবেক সেনাপ্রধান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান।

মাহবুবুর রহমান
আজকের আলোচনা নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর পর আজও গণতন্ত্র তার সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। এখানে সংসদ অকার্যকর এবং সাংঘর্ষিক রাজনীতি বিরাজমান। বাহাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত সংবিধান কিন্তু লঙ্ঘিত হয়েছে। সংশোধন করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের তিন বছরের মাথায় চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী করা হয়েছে। আজকের আলোচনায় পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়ের ফলে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। ভালো দিকটি হচ্ছে, জনগণের গণতন্ত্র চর্চার অব্যাহত ধারা বহাল থাকবে এ রায়ের ফলে। সংসদ কার্যকর করার প্রশস্ত পথ সৃষ্টি হয়েছে এই দুটি রায়ের মাধ্যমে। বর্তমানে রাজনৈতিক ধারা বা সংস্কৃতি অসুস্থ, দুর্বৃত্তায়িত, দুর্নীতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসবে, এটিই কিন্তু জনগণ প্রত্যাশা করছে। সেই প্রত্যাশা পূরণে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলকে সবাই স্বাগত জানাচ্ছে। আবার কোনো সামরিক শাসনের ভবিষ্যৎ দ্বার রুদ্ধ করার যে কথা এখন আলোচিত হচ্ছে, তা তাত্ত্বিকভাবে ঠিক আছে কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর চিত্রপট ভিন্ন।
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হয়েছে, শাসকদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে রায় দুটি কাজ করবে। কিন্তু সামরিক শাসন কখনো সাংবিধানিক উপায়ে আসে না। তারা এ আদালতের রায়গুলো মনে রাখার প্রয়োজন মনে করবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চরমভাবে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের অভাব লক্ষণীয়। যত দিন পর্যন্ত এসব দূর না হবে, দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক নিষ্ঠা, আস্থা ও বিশ্বাস না জন্মাবে, তত দিন পর্যন্ত আইন করে বা সংবিধান সংশোধন করে, আমি মনে করি, সামরিক শাসন আসা বন্ধ করার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা-চেতনা, সততা, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব রয়েছে। বর্তমানে সাংঘর্ষিক রাজনীতির যে ধারা দেখা যাচ্ছে, তা ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
আজকে আমাদের বড় প্রয়োজন জনসচেতনা সৃষ্টি করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সংসদকে কার্যকর করা। আজকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে সংসদের স্বাধীনতাকে হরণ করার জন্য। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবশ্যই জরুরি। বিচার বিভাগকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো উচিত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর অধীন থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরেকজন আলাদা ব্যক্তি হয়ে থাকেন। আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন রাখার দরকার কি, এটা সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদ পতনের পর তিনটি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে সেনাবাহিনীর সংযম ও আনুগত্য থেকেছে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করার পরও তারা গণতান্ত্রিক আদর্শের কাছে মাথা নত করে নিশ্চুপ থেকেছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমেই কেবল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে রাজনীতি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবে।

আব্দুল কাইয়ুম
মাহবুবুর রহমান অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। একটি হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। সংসদে সাংসদদের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করার জন্য এ ব্যাপারে কী করা দরকার, তা আলোচনায় আনার এখনই সময়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষয়। সব সময়ই কি তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকতে হবে? তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, দেশে রাজনীতির চর্চা। কতটা গণতান্ত্রিক ও সহনশীল? এসব বিষয়ে এখন আলোচনা করছেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ
আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে আমার উদ্বেগ প্রকাশ করতে চাইছি। বর্তমানের সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক অবস্থা থেকে আমাদের সহাবস্থানে আসতে হবে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটি আরও সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে। এখানে রাজনীতিবিদ, সাংসদ, জনগণ ও গণমাধ্যমের কী ভূমিকা পালন করা উচিত সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহারের জন্য, সে বিষয়ে আরও আলোচনা করা প্রয়োজন। জনগণ যে সংঘর্ষ চায় না, শান্তিতে বসবাস করতে চায়, সে বিষয়গুলো আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত। দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ও পারস্পরিক সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব রয়েছে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার একটি পরিস্থিতি রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গণতন্ত্রচর্চার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। আমি মনে করি প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু করতে হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য। উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত তৃণমূলে বাস্তবায়ন না করে জনগণের ধ্যান-ধারণা সংগ্রহ করে উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
আজকে মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ-সংকট, নিরাপত্তার অভাব কিংবা ঈদে বাড়ি যেতে পারছি না—এসব। তাদের সংবিধান সংশোধন নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের এসব সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত। সুন্দর প্রশাসন, আইনের শাসন—এগুলো নিয়ে যদি আমাদের রাজনীতি আবর্তিত হতো তবে আমরা আরও ভালো অবস্থানে থাকতাম।
বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সংসদের ওপর ন্যস্ত করা ছিল। কিন্তু পরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ও সামরিক শাসকেরা এ সুবিধাটি ভোগ করেছেন। সুতরাং আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করার যদি প্রশ্ন ওঠে, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর কথা উঠবে। আমাদের প্রকৃত গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না।
বর্তমানে সব পাওয়ার রাজনীতির প্রথা চালু রয়েছে। এ রাজনীতি থেকে সরে না এলে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতের রাজনৈতিক টেন্ডারবাজি বন্ধ করা যাবে না। ভবিষ্যতে সুস্থ রাজনীতির জন্য সব পাওয়ার রাজনীতির প্রকৃতি পরিবর্তন করে দেশের স্বার্থে কাজ করার রাজনীতির সংস্কৃতি কীভাবে করা যেতে পারে সেটি ভাবতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। জাতীয় সংসদকে আরও কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। এরপর যত পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা আছেন, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিতের মাধ্যমে সুস্থ রাজীতিতে প্রবেশ করা সম্ভব।
এটি সত্যিকার অর্থে বলতে পারি, আজকে আমাদের সমাজ বিভাজিত। বাহাত্তর সালে সমাজে এত শ্রেণীবৈষম্য ছিল না। তখন কোটিপতি ছিলেন মাত্র দুজন। আজকের দিনে ২৩ হাজারের বেশি ব্যক্তি কাগজে-কলমে কোটিপতি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসেবে। এ ছাড়া আরও অনেকে হিসাব ছাড়াও কোটিপতি। মনে করা হয় প্রায় এক কোটি লোক আমাদের সমাজে কোটিপতি। এটি আমাদের সমাজে একটি বিরাট পরিবর্তন। আমাদের দেশে শতকরা ৪০ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সে ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বিরাট শ্রেণীবৈষম্য দেখা যাচ্ছে, যা আমাদের সমাজে সংঘাত অনিবার্য করে তুলতে পারে, যেটি শ্রেণী সংঘর্ষ, দলীয় সংঘর্ষ নয়।
সুতরাং জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের আরেকটি দিক কিন্তু আমাদের সামনে আসতে পারে এর কারণে। কারণ ভোগবাদ দিয়ে সমাজকে বিভাজিত করে আমরা একটি সুস্থ সমাজ পেতে পারি না। সেদিকে আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বললাম কিন্তু শ্রেণীবৈষম্য দূর করার জন্য অগ্রসর না হলে কখনো এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না। সামাজিক নিরাপত্তা না দিয়ে সুস্থ সমাজ গড়া যায় না। কারণ এর মধ্যে দুর্নীতি থাকে। ভিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। দরিদ্র মানুষকে সক্ষম করার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা যায়। সক্ষমতা সৃষ্টি করার জন্য কী করা উচিত তা আগামী রাজনীতির চিন্তার বিষয়।
যাঁরা রাজনীতি করতে চান তাঁদের জনগণের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। যেটি বর্তমানে অনুপস্থিত। আমরা বহু সাম্প্রদায়িকতা অতিক্রম করে এসেছি, সুতরাং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থেকে কীভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে।
সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন প্রয়োজনে সরকার ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রধানদের মানসিকতা সম্পর্কে জানা ও তাঁদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্বও কিন্তু রাজনীতিবিদদের। এখানেই আমরা ব্যর্থ হয়েছি, ফলে বারবার সামরিক শাসকেরা এসেছেন।
আরেকটি দিক হচ্ছে, বর্তমানে রাজনীতি অনেকটা ব্যবসায়িক হয়ে পড়েছে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতিবিদদের মানসিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের, তাঁদের নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ যাতে ব্যাহত না হয় এবং তা সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে।

ড. শাহ্দীন মালিক
১৩০০-১৪০০ সালে আইনের উৎস হিসেবে গণ্য করা হতো গড বা সৃষ্টিকর্তাকে। তারপর রাজারা বলা শুরু করেন, তাঁরা সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে আইন করবেন। তারপর ১৭০০-১৮০০ শতকে গণতন্ত্র, মানে সংসদে জনপ্রতিনিধিরা, রাজাকে বাদ দিয়ে তাঁরা আইন করবেন বললেন। বিংশ শতাব্দীতে দেখা গেল তাঁরাও আইন করতে গিয়ে রাজার চেয়েও বেশি অন্যায় করেন। উদাহরণ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাশিয়া, জার্মানির হিটলার, মুসোলিনির ইতালি এঁরা সবাই ডেমোক্রেটস ছিলেন কিন্তু তাঁরা যে আইন করেছিলেন তা ছিল ভীষণ অন্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হলো, আইন করতে হলে কতগুলো মৌলিক বিষয় আইনের মধ্যে থাকতে হবে। তারপর রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া-কাঠামো দাঁড় করানো হলো।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হলো। যেখানে সংসদ আইন করতে পারবে কিন্তু কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে তা বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা থাকবে। আবার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আইন করার জন্য সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তার ফলে আমরা এমন একটি রাষ্ট্র হয়ে পড়ব, যেখানে আইন করার জন্য তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব। প্রথমত, সংসদ আইন তৈরি করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্ট আইনের বৈধতা ব্যাখ্যা দেবেন। তৃতীয়ত, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কারণে আইন করার জন্য সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। ধর্মগ্রন্থ থেকে আইন তৈরি করা হবে। কিছু ইসলামিক রাষ্ট্র সৌদি আরব বা ইরানে সরাসরি ধর্মগ্রন্থের আইন অনুসরণ করা হয়। তারপর সংসদ ও কোর্ট অনেক নিচের ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্যের ধর্মভিত্তিক দলগুলো আছে, কিন্তু তারা আইন করার ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার বিধান নিয়ে আসে না। সেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে না। কিন্তু আমাদের দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আইন করার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করবে বলে আমার আশঙ্কা। আর তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশে পাকিস্তানের মতো গোঁজামিল দেখা দেবে।
আমরা যদি সংবিধানে কোনো আবরণের মধ্যে ধর্মকে রেখে দিই, তাহলে ভবিষ্যতে সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা রয়ে যাবে। আমরা বলছি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকে যাবে। এ বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক অবস্থানে বিরাজ করবে সংবিধানে। সামনের নির্বাচনে জেতার আশা থেকে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো এই ইস্যু এড়িয়ে যাবে। সুতরাং যদি এই বিষয় এখনই সমাধান না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের মতো সংঘাতময় পরিস্থিতি রয়ে যাবে। আইনের এই তিন উৎস থাকলেই সেখানে সংঘাতময় রাষ্ট্র সৃষ্টির উদাহরণ রয়েছে। সেহেতু ধর্ম বিষয়টি এড়িয়ে গেলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারেন। বর্তমানে যেসব রাজনীতিবিদ আছেন, নেতৃত্ব পর্যায়ে প্রবীণ, ধারণা করি, সামনের নির্বাচন হয়তো তাঁদের জীবনের শেষ নির্বাচন। তাই সেই নির্বাচনে জেতার জন্য হয়তো তাঁরা ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সংবিধানকে কতটুকু সংশোধন করা হবে কিংবা কীভাবে আমরা সংবিধানকে দেখতে চাই, তা আগে ঠিক করতে হবে।
কারণ, সংবিধান একটি সমাজের ধ্যান-ধারণা, আদর্শের ধারক হিসেবে কাজ করে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ছোট আকারের। মাত্র সাতটি অনুচ্ছেদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচিত। আবার সংবিধানকে বিস্তারিত ব্যবস্থাপত্র হিসেবেও দেখা যায়। দেশ পরিচালনার সবকিছুই সংবিধানে উল্লেখ থাকে। যেমন ভারতের সংবিধানে। অর্থাৎ আমরা যদি আমাদের সংবিধান বিস্তারিত আকারে দেখতে চাই, তবে অনেক বড় ধরনের সংশোধন করতে হবে। আমার মত হচ্ছে, বাহাত্তরে যে ধরনের সংবিধান ছিল তার মৌলিক কাঠামো ঠিক রাখা উচিত। তারপর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংসদ ও কোর্টের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত যুগোপযোগী আইন করার জন্য।

আমিন আহমেদ চৌধুরী
আইন করে ভবিষ্যতে মার্শাল ল কিংবা সামরিক শাসন বন্ধ করা যাবে না। সামরিক শাসন বন্ধের জন্য গণতান্ত্রিক চর্চা অত্যন্ত জরুরি। যাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েও মন্ত্রিসভাকে কুক্ষিগত করতে চান, তাঁরাও এক অর্থে সামরিক শাসক হিসেবে বিবেচিত হবেন।
আমাদের আর্থসামাজিক, শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে সমস্যার কারণে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত বাহাত্তরের সংবিধান উপেক্ষা করে নিজেরা নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রচর্চা শুরু করেছি। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে সামরিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছি। আমরা সমগ্র পাকিস্তানে গণতন্ত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম, সে জন্য পাকিস্তানের ৯৬ ভাগ লোক গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। যার পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের আত্মপ্রকাশ করেছিলাম।
তৎকালীন সময়ে যাঁরা রাজনীতিবিদ ছিলেন, তাঁদের শ্রদ্ধা করা যায়। তাঁরা সমাজে গুণীজন ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতিবিদদের অনেককে শ্রদ্ধা করা যায় না। এ বিষয় বাদ দিয়ে শুধু আইন দিয়ে সমাজকে সব সময় শাসন করা যাবে না। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগুলোকে ভিত্তি করে নতুন করে এগিয়ে যেতে হবে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা পরিবর্তন করা দরকার। সেগুলো সবার মতামতের ওপর ভিত্তি করে পর্যালোচনার মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে। সমাজে প্রকাশ্যে বলতে হবে, ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনীতি এবং ধর্ম রাষ্ট্রের প্রশাসনে আসতে পারবে না।
ধর্মকে কুক্ষিগত করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের জগাখিচুড়ি ধরনের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস ও তার চর্চা করি, তবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নই আসে না। কারণ গণতন্ত্রই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র নাগরিকের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। আমরা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হই, তবে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করব। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অপকর্মে ব্যবহারের জন্য আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন (এএফডি) সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটা থেকে প্রচ্ছন্নভাবে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ করা হয়েছে। আমরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছি না এবং স্বাধীন মতামত দিতে পারছি না। সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে আইনজ্ঞরা বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দিয়ে সামরিক শাসকদের সহায়তা করেছেন। আমাদের সবার মানসিকতা পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জাগ্রত হতে হবে।

গৌতম দেওয়ান
সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার। যখন বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন থেকে একটি স্বপ্ন ছিল, অনগ্রসর সম্প্রদায় হিসেবে আদিবাসীদের সংবিধানে রাখা হোক। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের সঙ্গে আদিবাসীদেরও রক্ত মিশেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সংবিধানের কোনো অংশে আলাদা করে আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা হয়নি। ৪০ বছর ধরে আমরা নিরাপত্তার আশঙ্কার মধ্যে ভুগছি। বাহাত্তর সালে মানবেন্দ্র লারমা বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক, বহু সংস্কৃতির দেশ। সুতরাং আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। হয়নি বিধায় সেখান থেকে সূত্রপাত হওয়া দীর্ঘ দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাতের পথে আমাদের যেতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমাদের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি করেছিলাম। কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সে চুক্তির শর্তগুলো আদৌ পূরণ করা হবে কি না আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আদালতের রায়ে বলা হচ্ছে, সংবিধানের সঙ্গে চুক্তির অসংগতি রয়েছে। আমাদের যে চুক্তি হয়েছিল সরকারের সঙ্গে, সেখানে সংবিধানের ২৮-এর ৪ ধারায় মৌলিক অধিকারে নারী, শিশু ও অনগ্রসর জাতি কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে বলে উল্লেখ আছে। সে ধারা অনুযায়ী আদিবাসী বিভিন্ন কোটা সুবিধা ভোগ করতে পারছে।
কিন্তু আজকে আমরা যা অনুভব করছি তা পূরণ হচ্ছে না। অনগ্রসর জাতি বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে তার ব্যাখ্যা চেয়ে কোর্ট থেকে রায় দেওয়া হয়েছে। আমরা আদিবাসীরা এ দেশের নাগরিক। আমরা চাই, শুধু এ দেশের নাগরিক হিসেবে নাগরিক অধিকার ভোগ করতে। আমাদের সংবিধানে যেখানে নারী, শিশুশ্রমিকদের কথা আলাদা করে উল্লেখ আছে, সেখানে শুধু আদিবাসীদের কথা যুক্ত করে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু আদিবাসীদের কথা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে উল্লেখ নেই, তাই আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি সংশোধনী কমিটির কাছে, আমাদের কথা সংযোজন করার জন্য। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সারা বিশ্বে যেখানে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের কথা তুলে ধরা হচ্ছে, সেখানে কেন আমাদের কথা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে না। বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা উচিত। বর্তমানে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার যে সুযোগ এসেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা উল্লেখ করা যায় কি না, সে বিষয়ে ভাবতে হবে।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ
আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি সবার সঙ্গে একমত যে আইন করে কিংবা সংবিধানে কোনো অংশ যোগ করে সামরিক শাসন বন্ধ করা যাবে না। যেমন পাকিস্তানে ১৯৭৩-এর সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৬ যোগ করে বড় ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল সামরিক শাসন প্রতিহত করার জন্য, কিন্তু ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ফিরে এসেছিল। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। গণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট যে সংবিধানের যে সংশোধনই করি না কেন, সব দলের মতামত নিয়ে করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে নতুন কোনো সরকার এসে আবার পরিবর্তন না করে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে, ভবিষ্যতে সামরিক শাসন যাতে ফিরে না আসে। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা করতে হবে। পারস্পরিক আস্থা অর্জন করতে হবে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.