পাচার-দীপ্তির জন্য আলো ফিরিয়ে দিতে পারি না? by শেখ রোকন

দীপ্তির দুর্ভাগ্যের মধ্যেও সৌভাগ্য হচ্ছে, সীমান্ত পার হওয়ার পরপরই লোকজন টের পেয়েছিল। ফলে তাকে কোনো পতিতালয়ে আটক হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়নি। কুখ্যাত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবসার খোরাকে পরিণত হতে হয়নি। কিরিটি রায়দের সংগঠনের নজরে পড়ার বিষয়টিও তার জন্য মঙ্গলজনক হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।


অন্যথায় তাকে হয়তো বিনাবিচারে কিংবা বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার শিকার হয়ে অনিশ্চয়তার কাছে প্রাণভিক্ষা করতে হতো। দীপ্তির ভাগ্যে আসলে কী ঘটবে, এখনও নিশ্চিত নয়; আমরা আশা করতে পারি, কিরিটি রায়ের চিঠি ঠিক ঠিকানায় পেঁৗছবে


দিন কয়েক আগে বেলারুশ থেকে ফেসবুক ফ্রেন্ড বোরিসের মেসেজ_ 'হ্যালো রোকন! আমাদের সরকার ফেসবুক, টুইটার ও ফ্কনতাকতে (ঠকড়হঃধশঃব), ফেসবুকের রুশ ভার্সন বন্ধ করতে চাইছে। সরকারের অবস্থা বোধ হয় সত্যিই খারাপ, এখন এসব পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে। আমি অবশ্য এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত নই; কিন্তু খবরটি সমানে রি-পোস্টিং চলছে।' এর সঙ্গে তিনি যে খবরের লিংক দিয়েছেন গুগল ট্রান্সলেশনে তার মর্মার্থ হচ্ছে_ সরকার দু-এক দিন বা সপ্তাহের মধ্যে ফ্কনতাকতে বন্ধ করতে যাচ্ছে। রুশ ওই সোশ্যাল নেটওয়ার্কভিত্তিক কয়েকটি গ্রুপের মডারেটরকেও বেলারুশ সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন ধরে নিয়ে গেছে। আটক তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা পরিবেশবিষয়ক গ্রুপের আড়ালে বেলারুশের বর্তমান শাসনব্যবস্থার বিরোধীদের সংগঠিত করছিল। বোরিসের দেশের এমন পরিস্থিতিতে কিছু সান্ত্বনা ও সমর্থনবাক্য ছাড়া আর কী বলার থাকে? কিন্তু আমার সাংবাদিক পরিচয় মাথায় রেখেই বোধ হয় তিনি দু'দিন পর ফের মেসেজ পাঠিয়েছিলেন_ যদিও তখনও সরকার ফেসবুক বা ফ্কনতাকতে বন্ধ করেনি; কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সক্রিয় কমবেশি ২০০ তরুণকে এক দিনে আটক করেছে। বেলারুশজুড়ে বোরিসের ভাষায়, এর বিরুদ্ধে চলছে 'নীরব বিক্ষোভ'। সরকারের এ পদক্ষেপ ও অর্থনীতি সামাল দিতে ব্যর্থতার বিরুদ্ধে অনলাইনে ঝড় বইছে। প্রথমবারের মতো নেতাহীন, বক্তৃতাহীন, দলীয় ঝাণ্ডাবিহীন এক বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছে তার দেশবাসী।
না সংবাদপত্র, না রেডিও-টেলিভিশন; বিশ্বের এক প্রান্তের তথ্য আরেক প্রান্তে এখন কীভাবে পেঁৗছে যাচ্ছে, বোরিস ও আমার বার্তা-বিনিময় এর একটি খণ্ডচিত্র। হয়তো এ ক্ষেত্রে আমার করার কিছুই নেই; কিন্তু যাদের করার আছে, তারা কিন্তু করতে পারে অনেক কিছুই। বস্তুত তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির প্রসার কীভাবে অ্যাক্টিভিজমে নতুন মাত্রা যুক্ত করছে, তার খণ্ডচিত্র আমরা তিউনিসিয়াসহ আরববিশ্বের কোথাও কোথাও দেখেছি। এস্টাবলিশমেন্টের নজর ও খবরদারি এড়িয়ে আধুনিক গোকুলে কীভাবে নতুন প্রতিপক্ষ বেড়ে উঠছে, তা এখন মোড়লদের মাথাব্যথার কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে এ ধরনের তৎপরতা আরও বাড়বে। রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর হুশিয়ার কিংবা বিনির্মিত হওয়ার সময় হয়েছে। শুধু কি রাজনীতি? সাইবার-জগতের বাসিন্দারা জানেন, আরও অনেক বিষয়েই নতুন বাস্তবতার জন্ম হচ্ছে। বিচিত্র বিষয়ে অনলাইনভিত্তিক নানা 'গ্রুপ' অফলাইনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। আমি নিজেও এমন কিছু গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত।
এমন একটি গ্রুপ হচ্ছে 'অ্যাক্টিভিজম নিউজ নেটওয়ার্ক'। গুগলভিত্তিক ওই গ্রুপে ইন্টারেস্টিং অথচ গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতার খবর থাকে; থাকে স্মারকলিপি, চিঠি ও নথিপত্র। যে কারণে মাঝেমধ্যেই ঢুঁ মারি। বলা বাহুল্য, সেখানে বাংলাদেশের খবর খুব একটা থাকে না; থাকে মূলত ভারতের। তবে অনেক ঘটনা ও এর প্রতিক্রিয়া সীমান্তের এপারের জন্যও প্রাসঙ্গিক, ছায়া-তাৎপর্যপূর্ণ; কিন্তু খানিকটা বিলম্বে চোখে পড়া জুনের প্রথম সপ্তাহে পোস্ট করা একটি ই-মেইল ছিল সরাসরি বাংলাদেশের বিষয়ে। সময় ও ব্যাপ্তির বিচারে গা-সওয়া অথচ শিউরে ওঠা একটি বিষয়ে।
ই-মেইলের প্রেরক 'বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ' নামে পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক একটি সংগঠনের সেক্রেটারি কিরিটি রায়। তিনি আবার 'প্যাক্ট' (প্রোগ্রাম এগেইনস্ট কাস্টডিয়াল টর্চার অ্যান্ড ইমপিউনিটি) নামে আরেকটি সংগঠনের জাতীয় সমন্বয়ক। প্রাপক হচ্ছেন ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সিসি দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিএসএফ মহাপরিচালকসহ আরও কয়েকজনকে। বিষয়_ বাংলাদেশ থেকে কিশোরী পাচারে বিএসএফ ও পুলিশের চক্র।
মেইলে তিনি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে জানাচ্ছেন, মিস দীপ্তি শেখ নামে ১৭ বছরের এক বাংলাদেশি কিশোরী দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বিচারাধীন হাজতি হিসেবে আটক রয়েছে। দীপ্তি জাতিতে মুসলিম, তার বাবার নাম শাহজুল হোসেন, বাড়ি ঢাকার দুহারিতে (দোহার?)। ওই কিশোরী স্বরূপনগর থানায় ২০১০ সালের ২৮ মে ফরেনার্স অ্যাক্টের ১৩/১৪ ধারায় দায়ের করা এক মামলার (নম্বর-২১৯/২০১০) আসামি। পুলিশ এরই মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট অ্যাডিশনাল চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দীপ্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে।
কিন্তু কিরিটি রায় ও তার সহকর্মীরা জানতে পেরেছেন, দীপ্তি আসলে নারী পাচারকারী সদস্যের পাল্লায় পড়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছে। 'লাইনম্যানরা' বিএসএফ ও বিজিবিকে ম্যানেজ করে তাকে হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে পাচার করে। রাতে তাকে হাকিমপুরের একটি বাড়িতে রাখা হলে স্থানীয় লোকজন পাচারের বিষয়টি টের পায় এবং হইচই শুরু করে। তখন তাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালানোর সময় পাচারকারীরা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার স্বরূপনগর থানা এলাকায় বিএসএফের হাতে আটক হয় এবং তিনজনকেই থানায় সোপর্দ করা হয়। কিন্তু পুলিশ দীপ্তির বিরুদ্ধে 'অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের' অভিযোগ আনে। আটক অন্য দু'ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাচারের বদলে অবৈধ প্রবেশে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়। কিরিটি রায় পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর তদন্ত ও প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন।
দীপ্তির দুর্ভাগ্যের মধ্যেও সৌভাগ্য হচ্ছে, সীমান্ত পার হওয়ার পরপরই লোকজন টের পেয়েছিল। ফলে তাকে কোনো পতিতালয়ে আটক হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়নি। কুখ্যাত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ের খোরাকে পরিণত হতে হয়নি। কিরিটি রায়দের সংগঠনের নজরে পড়ার বিষয়টিও তার জন্য মঙ্গলজনক হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। অন্যথায় তাকে হয়তো বিনাবিচারে কিংবা বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার শিকার হয়ে অনিশ্চয়তার কাছে প্রাণভিক্ষা করতে হতো। দীপ্তির ভাগ্যে আসলে কী ঘটবে, এখনও নিশ্চিত নয়; কিন্তু সে হয়তো আরও শত শত দরিদ্র ও দুর্ভাগা কন্যাশিশুর করুণ পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে না। আমরা আশা করতে পারি, কিরিটি রায়ের চিঠি ঠিক ঠিকানায় পেঁৗছতে পারবে। এদিক থেকে বাংলাদেশ সরকার, নিদেনপক্ষে দিলি্ল বা কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসও বিষয়টি আমলে নিতে পারে। তাহলে অন্তত একজন কিশোরীকে পাচার ও অমানুষিক জীবনের হাত থেকে রক্ষার গৌরবের অংশীদার হতে পারবে। নারী ও শিশু পাচার নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোও কি নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসতে পারে না? ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের কাছে লেখা চিঠি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পড়তে পারবেন না, এমন কোনো বিধান নেই।
একই সঙ্গে নারী ও শিশু পাচার বন্ধেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বীকার করি বা না করি, প্রতিদিন পাচারকারীর প্রলোভনে বা পাল্লায় পড়ে সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে সভা-সেমিনার হয় বটে; কাজের কাজ খুব একটা নেই। শোনা যায়, পুরনো আইন দিয়ে কাজ হচ্ছে না। আইন যাও আছে, প্রয়োগ নেই। সীমান্তে গড়ে উঠেছে পাচারের সর্বনাশা চক্র; কিন্তু পাচার বন্ধ হচ্ছে না। দীপ্তির চোখে আলো জ্বালানোর মধ্য দিয়েই আমরা কি সেই দুরূহ কাজটির সূচনা করতে পারি না?

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.