অভিমত ভিন্নমত

জনগণের সেবক হতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-সাংসদ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সাধারণ জীবন যাপন করতে হবে, সাধারণ মানুষের কল্যাণের স্বার্থে বিলাসিতা ত্যাগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বারবার মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর কথা।


তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েও বাস করেছেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে, যেটি অতি সাধারণ একটি বাড়ি, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে যেটি মানায় না বললেই চলে। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল আন্তরিক। কারণ তিনি উঠে এসেছিলেন একদম সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে। তিনি সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের শান-শওকত, বিলাসিতা পছন্দ করতেন না। তাঁর একটি ভাষণের কথা মনে পড়ছে—এই রকম: ‘সরকারি কর্মচারী ভাইদের বলি, বারো বৎসর পর্যন্ত আইয়ুব খানের আমলে থাইকা আপনাদের অনেকেরই মাথা অনেকটা খারাপ হয়্যা গেছে। আপনারা সম্পূর্ণ পাওয়ারের অধিকারী ছিলেন। আপনারা জনগণের সঙ্গে আসলে অ্যাডজাস্ট করতে পারেন না। আপনাদের...আমি বড়লোক কর্মচারীদের কথা বলছি; গরিবদের কথা বলছি না-গরিবরা আমার দলে সব। তাদের বলব, মগজটা একটু ঠিক কইরে ফেলান। আগের দিনের কথা ভুলে যান। জনগণের...খাদেম হতে হবে, জনকর্তা হলে চলবে না। মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। ওদের ট্যাক্সে, ওদের পয়সায় আপনাদের সংসার চলে...।’
সেই প্রসঙ্গ টেনে বলছি, আমরা গরিব জনসাধারণ ভোট দিয়ে সাংসদদের নির্বাচিত করি জনগণের সেবা করার জন্য, তাঁরা নিজেরা বিলাসী জীবন যাপন করবেন এ জন্য নয়। আমাদের সাংসদদের কেন সাড়ে চার হাজার সিসির গাড়ি দরকার? এত দামি গাড়ি শুল্কমুক্ত আমদানি করার সুযোগ তাঁরা নিজেরাই নেবেন কেন? এটা কি জনসেবার লক্ষণ? অতীতে আমরা দেখেছি, দুই-তিন কোটি টাকা দামের গাড়ি শুল্কমুক্ত আমদানি করে বিক্রি করে দিয়েছেন কোনো কোনো সাংসদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেসব ধরাও পড়েছিল। তখন তাঁদের মুখ দেখানো উপায় ছিল না। এত তাড়াতাড়ি তাঁরা সেসব ভুলে যাচ্ছেন কী করে?
এমনিতে বিভিন্ন দলের সাংসদদের মধ্যে বনিবনা নেই; বিরোধীদলীয় সাংসদেরা তো সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে পছন্দ করেন না। কিন্তু যখনই সাংসদদের বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন সব সাংসদ একজোট হয়ে সংসদে হাজির হন, একযোগে তালি বাজিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেন। দেখে মনে হয় যেন তাঁরা সবাই একই দলের সাংসদ। সংসদে যেন বিরোধী দল বলে কিছু নেই, কেবলই সরকারি দল। আশ্চর্য হয়ে ভাবি, আমাদের এই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কি নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেন না? তাঁদের বিবেক কি একটুও নাড়া খায় না? যে দেশের সিংহভাগ জনসাধারণের দারিদ্র্য ও দুঃখ-দুর্দশা প্রকট, সেই দেশের গরিব জনগণের করের টাকায় তাঁরা বিলাসী জীবন যাপন করবেন—এটা কেমন করে হয়? এই জিজ্ঞাসা কি তাঁদের মনে একবারও জাগে না?
আবার দেখছি, সাংসদদের নাকি আয়কর দিতে হবে না। এটা কেমন কথা? কেন তাঁরা আয়কর দেওয়া থেকে মুক্ত থাকবেন? দেশের মানুষের আয়কর দেওয়া বাধ্যতামূলক, কেউ আয়কর না দিলে সরকার তাঁকে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যেতে পারবে, তাহলে সাংসদেরা কেন আয়কর দেওয়ার ঊর্ধ্বে থেকে যাবেন? নিজেদের সুবিধামতো আইন-কানুন পাস করে নিলেই কি তাঁর ন্যায্যতা থাকে? তাই আমরা জনসাধারণ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, সাংসদদের এমন বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন, যা এই গরিব দেশের গরিব জনগণের কাছে নির্দয়, কষ্টদায়ক এবং চরম বৈষম্যমূলক বলে মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করুন, আপনাদের জনগণের সেবক হতে হবে, গরিব জনগণের করের টাকায় নিজেদের বিলাসী জীবন যাপনের চর্চা পরিহার করতে হবে।
সৈয়দ পারভেজ রহিম
ইব্রাহিমপুর, কাফরুল, ঢাকা।
domain.payel786@gmail.com

প্রযুক্তির অপব্যবহার
ই-মেইল, ইন্টারনেট, এসএমএস, চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল ফোন—এসব উন্নত প্রযুক্তি আজ পৌঁছে গেছে সারা বিশ্বের দুয়ারে। আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশে আমরা পাচ্ছি প্রযুক্তি। বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন একশ্রেণীর মানুষ এসব প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। নারীবিরোধী অনেক কাজের পাশাপাশি তারা করছে জঘন্য কিছু কাজ। বিভিন্ন সাইটে তারা দিচ্ছে মেয়েদের মুঠোফোন নম্বর, নাম ও মেয়েটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তারা কোথা থেকে কীভাবে এত নম্বর জোগাড় করছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নম্বরগুলো নেওয়া হচ্ছে ফ্লেক্সিলোড অর্থাৎ টাকা রিচার্জের দোকান থেকে। কিছু ক্ষেত্রে পরিচিতজনের মাধ্যমেও নম্বরগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে।
একটা সময় ছিল তখন আমরা দেখতাম টাকার ওপরে মেয়েদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা এবং ওই মেয়ে সম্পর্কে অনেক অশ্লীল উক্তি। তারপর বাড়তে থাকল মুঠোফোনের ব্যবহার। শুধু টাকায় নয়, বাসস্টপ, ট্রেনের কামরা, বিদ্যালয়ের টয়লেটের দেয়ালে লিখে রাখা হচ্ছে মেয়েদের মুঠোফোন নম্বর ও ঠিকানা। এখন যুগ আরও আধুনিক হয়েছে। এখন মেয়েদের মোবাইল ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে।
ভুক্তভোগী নারীরা আজ মুঠোফোন ব্যবহারে আতঙ্কবোধ করছে। এর প্রতিরোধে সমাজের সচেতন মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু আইনই যথেষ্ট নয়, আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।
আসকার ইবনে সাঈদ
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সামরিক স্বৈরাচারের বিচার হবে না?
মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পোস্টারে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার মুখাবয়বের ওপর এক হায়েনার ছবি ছিল। তাঁর পাশবিক দন্তপাটি থেকে ছিটকে পড়ছে রক্ত। ছবির ক্যাপশান ছিল ‘এসব জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। পোস্টারটি এঁকেছিলেন আমাদের সবার প্রিয় পটুয়া কামরুল হাসান। আবার তিনিই তাঁর জীবনাবসানের কয়েক মিনিট আগে আরেকটি যুগান্তকারী ছবি এঁকেছিলেন, যাতে ছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের মুখাবয়ব। সেই ছবির ক্যাপশন ছিল, ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’।
ইয়াহিয়া খানের মতো জানোয়ারদের আমরা বাংলার মাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি, প্রতিষ্ঠা করেছি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের এক স্বৈরশাসক, কামরুল হাসানের সেই বিশ্ববেহায়াকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেও তার কবল থেকে দেশ আজও পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। শিল্পী কামরুল হাসান বেঁচে থাকলে হয়তো আজ আবার এক নতুন ছবি এঁকে তার ক্যাপশন লিখতেন: ‘বিশ্ববেহায়াদের কবলে আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি’।
আজ আমরা দেখছি, সেই বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচারী এরশাদ ও তাঁর চতুর রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আদালতের রায়ে তাঁর স্বৈরশাসন পুরোটাই বাতিল ঘোষিত হওয়ার পরও তাঁকে শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়ার ফন্দি-ফিকির খোঁজা হচ্ছে। আর সেই বিশ্ববেহায়া নিজেই বলছেন, তিনি নাকি বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতা দখল হতে শুরু করে তাঁর জারি করা যাবতীয় ফরমান, যা সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে জায়েজ করা হয়েছিল, সব বাতিল ঘোষণা করেছেন। সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায় দিতে গিয়ে আদালত এরশাদের ক্ষমতা দখলের কঠোর সমালোচনা করে তা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং ঘোরতর অপরাধ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বিচার করা যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে বিজ্ঞ মহলে পাল্টাপাল্টি মতামত লক্ষ করছি। কিন্তু দেশে প্রচলিত ফৌজদারি আইন অনুযায়ী তাঁর কিছু কিছু অপরাধের বিচার কেন করা যাবে না, তা বোধগম্য নয়। ছাত্র-শ্রমিকসহ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের সময় যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে কি এরশাদ মুক্তি পেতে পারেন? তিনিই তো সেসব হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বলে, তাতে মনে হয়, বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে কিংবা সশস্ত্র বাহিনী আইনে (শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে) এরশাদের বিচার করা সম্ভব। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সামরিক আইন ঠেকাতে আজ যাঁরা নতুন আইন প্রণয়ন করতে চাইছেন, তাঁদের কি জানা নেই, যাঁরা সামরিক শাসন জারি করেন, তাঁরা কোনো আইনের ধার ধারেন না? অতীতে যতবার সামরিক শাসন এসেছে, সংবিধান লঙ্ঘন করেই তা এসেছে। ভবিষ্যতেও সামরিক আইন এলে কোনো আইনেই তা ঠেকানো যাবে না। কিন্তু যখন স্বৈরশাসকদের বিচার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে, তখন একটা সাবধানবাণী পৌঁছে যাবে যে ভবিষ্যতের স্বৈরশাসকদের বিচার হবে। বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার আগে তাঁদের ১০০ বার ভেবে দেখতে হবে।
নয় বছরের শাসনামলে এরশাদ কী কী অপকর্ম করেছেন, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে একটি বিষাদ-সিন্ধু লিখতে হবে। আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে ২৪ জানুয়ারি, ১৯৮৮ সালের ঘটনা। লালদীঘির মাঠে ১৫ দলীয় জনসভা। সেদিন শেখ হাসিনাসহ ১৫ দলের নেতাদের বহনকারী গাড়িতে এরশাদের নির্দেশে পুলিশ-বিডিআর যেভাবে গুলি চালিয়েছিল, তা যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট না হতো, তাহলে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক জাতীয় নেতা পরপারের যাত্রী হতেন। আজ আমরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে পেতাম না। ২৯ জন লোক সেদিন লাশ হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম-নির্বিশেষে সেই লাশগুলোকে চট্টগ্রামের অভয় মিত্র শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এটা তো ছিল গণহত্যা। এই গণহত্যার দায় কি কারও ওপর বর্তায় না? এ জন্যও কি এরশাদের বিচার হওয়া উচিত নয়?
মো. জানে আলম, চট্টগ্রাম।

বাঘ কেন লোকালয়ে ঢোকে
অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বাঘ অধিক হিংস্র। এমন হিংস্র যে লোকালয়ের আশপাশে বাঘের কথা চিন্তাই করা যায় না। সেটা কেবল মানুষের দিক থেকে নয়, বাঘের দিক থেকেও। বাঘও সাধারণত লোকালয়ের দিকে আসতে চায় না, নিজের আবাসস্থল, অর্থাৎ বনে-জঙ্গলেই তারা স্বস্তি বোধ করে। তা ছাড়া মানুষ যেমন বাঘকে ভয় পায়, তেমনি বাঘও মানুষকে ভয় পায়। কারণ মানুষ বাঘ দেখলেই হত্যা করতে চায়।
সেই বাঘ কেন হঠাৎ হঠাৎ লোকালয়ে চলে আসে? সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে জানা যায়, সুন্দরবনের উপকণ্ঠের বিভিন্ন লোকালয়ে বাঘ হানা দিয়েছে। মানুষ, গরু, ছাগল বাঘের হামলার শিকার হচ্ছে। কিন্তু বাঘ লোকালয়ে ঢোকে কেন? প্রথমত, বনে বাঘের পর্যাপ্ত খাবারের অভাব দেখা দিলে ক্ষুধার্ত বাঘ কোনো উপায়ান্তর না দেখে লোকালয়ের দিকে চলে আসে গুরু, ছাগল প্রভৃতি পশু শিকার করে প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়ত, বাঘের নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস করলে বাঘের শান্তি নষ্ট হয়, তাকে বিরক্ত করা হয়। ঘন গাছপালা কেটে বন উজাড় করলে বাঘ নিজেকে বিপন্ন অবস্থার মধ্যে দেখতে পায়। সুন্দরবনের গাছপালা কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। বাঘের বাসস্থান আজ বিপন্ন। তাদের নিরিবিলি, নিভৃতিতে বাস করার অধিকার মানুষ ধ্বংস করছে। ফলে বাঘ সুন্দরবনের আশপাশের বন ধ্বংসকারী লোকজনের ঘরে হানা দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। তাই মানুষসহ গরু-ছাগলকে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। এরই মধ্যে অনেক মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা গেছে। অনেকের গুরু-ছাগলও আক্রান্ত হয়েছে বাঘের দ্বারা।
এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। পদক্ষেপের কথা বলা হলেও তা ভালোভাবে কার্যকর করা হয় না। প্রথম কথা হচ্ছে, প্রাকৃতিক বনকে বনের মতোই থাকতে দিতে হবে। সেখানে মানুষের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবন পৃথিবীর এক বিরল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য; এর ইকোসিস্টেমে যাতে কোনো ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য মানুষের পদচারণ একদম কমিয়ে ফেলতে হবে। বন উজাড় করে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে অত্যন্ত কঠোর হস্তে। বন বিভাগের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বনজ সম্পদ লোপাটের মহাযজ্ঞ বন্ধ করতে বন বিভাগের কর্মীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি।
মো. তানজিল, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
tanji_cu88@yahoo.com

উত্ত্যক্তকরণ রোধে যা করা দরকার
ইভ টিজিং আর রাস্তায় দু-চারটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। চলতি বছরের আট মাসে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ১৪-১৫ জন কিশোরী। এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
সব কিশোরী ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে প্রথমেই আত্মহত্যা করছে এমন নয়। শিকার হওয়ার পর তাদের মধ্যে যে আত্মগ্লানির সৃষ্টি হচ্ছে, মা-বাবা, ভাই-বোন কারও কাছেই সে মন খুলে বলতে পারছে না। এই বয়ঃসন্ধিকালে একদিকে নিজের মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন, অন্যদিকে অশালীন উক্তি ও পরিবারের অসহযোগিতা বা অসংবেদনশীলতার চাপ। এসব যখন তার পক্ষে অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন সে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করছে। এমন অভিভাবক খুব কমই আছেন, যাঁরা সন্তানদের এসব ব্যাপারে সচেতন। যদি তাঁদের এই উপলব্ধিটি করানো যায় যে মেয়ে হারিয়ে অসহায়ের মতো আহাজারি করার চেয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলে পরিবারের এত আদরের এই সদস্যটিকে হারানোর আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে যায়, তাহলে ্রনিশ্চয়ই সব অভিভাবকই অন্তত এ ব্যাপারে সচেতন হবেন।
ইভ টিজিং ঠেকানোর জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষে নিয়েছে। নতুন আইন প্রবর্তন, আইন সংশোধন, শাস্তি বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। বুদ্ধিজীবীরা বলছেন,্রকাউন্সেলিং করে তাৎক্ষণিকভাবে আত্মহত্যা কমানো প্রায়ই সম্ভব নয়, এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, নতুন আইন প্রণয়ন হতে হতে আমরা যদি আরও কিছু তাজা প্রাণ হারিয়ে ফেলি, তাহলে এ আইন তখন কার কল্যাণে আসবে? আত্মহত্যা প্রতিহতকরণে তাৎক্ষণিকভাবে বেশকিছু পদ্ধতি অবলম্বনের প্রস্তাব করা যেতে পারে: ১. দেশের সব স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া—তারা যেন সপ্তাহে অন্তত এক দিন অভিভাবকদের সঙ্গে সভা করে সন্তান-অভিভাবক সম্পকর্কে বন্ধুসুলভ করার আহ্বান জানান। আর স্কুল থেকে আমন্ত্রিত হলে অভিভাবক যেন সচেতনভাবে ব্যাপারটি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে কথা বলবেন। এতে কিশোরীরা একাকীত্ব অনুভব করবে না এবং তারা মনের অনুভূতিও জানাতে পারবে। ফলে আত্মহননের প্রবণতা কমবে। ২. জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পথে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেবে। ৩. ভোটার তালিকা তৈরির সময় টিম গঠন করে যেভাবে কাজ করা হয়, তেমন টিম গঠন করে ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো জানা এবং মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। নারীদের নিয়ে এ রকম দলগত কাজ করা হলে গ্রামাঞ্চলেও ছাত্রীরা তাদের সব অভিযোগ সহজেই তাদের জানাতে পারবে এবং ভুক্তভোগীরা এই টিমের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে আইনগত সহযোগিতার আবেদন করতে পারবে। ৪. অপরাধীর বিচারকাজ যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়, এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া। ৫. সর্বোপরি এসব কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা। পরিশেষে বলা যেতে পারে, আমরা যদি কিশোর-কিশোরীদের প্রকৃতপক্ষেই দেশের ভবিষ্যৎ মনে করি এবং তাদের এই দুঃসময়ে আমরা নিজেরা তাদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে এই সমস্যা লাঘব করা সম্ভব।
শুভাগত সরকার মজুমদার
ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, স্টামফোর্ড ইউনির্ভাসিটি, বাংলাদেশ।

এই শিশুদের জন্য আমরা কী করছি?
সকালবেলা বেশির ভাগ মানুষের মন নির্মল ও সুন্দর থাকে, হূদয়ে থাকে একটা পবিত্র ভাব। ঘর থেকে বের হয়ে যদি নির্ঝঞ্ঝাট বাহন পেয়ে উঠে পড়া যায়, হয়ে যায় বসার সিটের বন্দোবস্ত, তবে তো কথাই নেই। খুশি মনে বাইরে তাকাতেই টাটকা খবরের কাগজ, দাম মাত্র দুই টাকা। কী চমৎকার! ইদানীং এ ব্যবস্থা রয়েছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্যস্ততম সড়কেই। গাড়ির জানালা, ডানে-বাঁয়ে ও ভেতরে চারদিক থেকে কানে আসছে আহ্বান: ‘পেপার নিবেন, পেপার।’ অমনি মনটা চনমনে হয়ে ওঠে, চোখ দুটি আটকে যায়, যতটা না বেশি পত্রিকা কেনার জন্য, ততধিক ওর বাহক হকার নামের ওই শিশুদের মুখমণ্ডলের ওপর। ধীরে ধীরে ওদের ললাট, চোখ, গণ্ডদেশ বেয়ে চিবুক ও পরে পোশাক, স্বাস্থ্যের ওপর। চোখ এড়ায় না ওদের অপুষ্টি-অনাহারের সুস্পষ্ট ছাপগুলো।
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে বাসে চড়ে আগারগাঁও ক্রসিং সিগনালে পৌঁছেছি, ক্ষণিকের বিরতি, দৃষ্টি আটকে গেল দৈনিক খবরের কাগজবাহী দুই শিশু হকারের দিকে। বয়স ৮ ও ১০ বছরের মধ্যে। দুজনের এক হাত পরস্পরকে ধরা ও অন্য হাতে কাগজের বান্ডিল বুকের সঙ্গে ধরা। বাস সিগনালে থামতেই হাত ছুটে দুজন দুই দিকে ছুটে গেল ওগুলো বিক্রি করতে।
৩ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানতে পারলাম, বাসের চাকায় পিষ্ট হয়েছে পত্রিকা-বিক্রেতা ১০ বছর বয়সের ইমন। সংসারের অভাব ঘোচাতে ঢাকায় এসেছিল টাকা আয় করতে। পত্রিকা বিক্রির সময় মগবাজার মোড়ে একটি বাস তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিধবা মায়ের স্নেহের কোল ছেড়ে ছোট শিশু নিজের বেঁচে থাকা ও মায়ের অভাবের মোকাবিলা করতে এসে নিষ্ঠুর বাস্তবতার দংশনে ঝরে গেল। শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশুর যৌন নিপীড়ন, শিশুর ক্ষুধা, শিশুর আশ্রয়হীনতা, শিশুর বন্দিত্ব, শিশুর রক্তাক্ত, ঝলসে যাওয়া লাশ, নিপীড়িত শিশুর হতবাক চেয়ে থাকা! আর যেন সহ্য করা যায় না। আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সমাজ কী করছে এই শিশুদের জন্য, যাদের এখন স্কুলে যাওয়ার বয়স? স্কুলের পর খেলাধুলা, হাসি-আনন্দে দিন কাটানোর বয়স?
রোজলীন্ড বাসবী হালদার, মিরপুর, ঢাকা।

জনবিস্ফোরণের পথে বাংলাদেশ
ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোরে ফেরার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। পথে ধলেশ্বরী নদী দেখে কবিগুরুর ‘বাঁশি’ কবিতার ‘সদাগরি অপিসের কনিষ্ঠ কেরানি’ সেই বিরহী প্রেমিকের পিসিদের গ্রামখানা একবার দেখার জন্য মনটা আনচান করে উঠল। পুরো কবিতাটা বিএড প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার জন্য নির্ধারিত থাকায় মুখস্থ করতে হয়েছিল। এই কবিতাটা আবৃত্তি করার সময় চোখ বুজলেই সেই বিরহী প্রেমিকের জীবন থেকে পালিয়ে যাওযার হূদয়মথিত মর্মভেদী দীর্ঘশ্বাস আজও শুনতে পাই। দেখতে পাই, ‘কপালে সিঁদুর’ দেওয়া ‘ঢাকাই শাড়ি’তে অবগুণ্ঠিতার ভাবলেশহীন এক জোড়া চোখ। দুজনের মাঝ দিয়ে বিশাল বিস্তৃত ধলেশ্বরীর বয়ে চলা।
ধাক্কা খেলাম দুই টুকরো হয়ে বয়ে চলা ক্ষীণকায়া ধলেশ্বরীকে দেখে। কবিগুরু যখন কবিতাটি লিখেছিলেন, তখন বোধকরি ধলেশ্বরীর অঙ্গে ছিল ভরা যৌবন। পিসিদের গ্রাম চোখে না পড়লেও ইটভাটার চিমনি আর আবাসন প্রকল্পের বাহারি নামের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি। স্বপ্নভঙ্গ হতেই পথের ডান দিকে চোখ ফেরালাম। শাপলা-শালুকেরা মাইলের পর মাইলজুড়ে সাদা ও রঙিন ফুলের পসরা সাজিয়ে প্রকৃতিকে অপরূপ করে তুলেছে। দেখলাম, নারী-পুরুষেরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে শাপলা তুলছেন। সেই বিলের মধ্যেও ভূমিদস্যুদের আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ডের আধিক্য দেখে মনে হলো, পাঁচ বছরের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে যাবে বিশাল সব অট্টালিকা। গিজগিজ করবে মানুষ। উধাও হয়ে যাবে বিস্তীর্ণ শাপলা দিঘি।
যেভাবে মানুষ বাড়ছে, সেভাবে সবকিছুর চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাসস্থান চাই, শিক্ষা চাই, চিকিৎসা চাই। এগুলো একদমই মৌলিক চাওয়া। এর পরও আছে নানা রকমের চাওয়া। প্রতিদিন, প্রতিবছর বাড়ছে সেসব চাওয়া; চক্রবৃদ্ধি হারে। আমাদের এই ছোট অথচ অপরূপ লাবণ্যে ভরা দেশটার চেহারা ক্রমেই বিবর্ণ, মলিন, কদর্য হয়ে ওঠার এক মস্ত কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি।
বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার সময় এসেছে। আমরা দেখেছি, আশির দশকে পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। পরে কোন অজানা কারণে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে জানি না। তবে জরুরি ভিত্তিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, নইলে সরকার আজ যে জনগণকে সম্পদ ভাবছে, কাল তা জনবিস্ফোরণে পরিণত হয়ে জাতির জন্য মহাদুর্ভোগের কারণ হবে।
শ্রাবণী সুর, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, যশোর।

মধ্যবিত্তের আত্মযন্ত্রণা
প্রথম আলোর অর্থনীতির পাতায় ৩ সেপ্টেম্বর ‘এশিয়ার উন্নয়নযাত্রা ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত’ শিরোনামে হানিফ মাহমুদের একটি লেখা পড়লাম। আমরা যারা গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, আমাদের কাছে ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ ছিল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। মধ্যবিত্ত বলতেই ধরে নিতাম সুবিধাবাদী, লুম্পেন, দুর্নীতিবাজ, নীতিহীন, পরশ্রীকাতর ও ভদ্রলোক।
জীবনের চাকায় গড়াতে গড়াতে আজ আমি নিজেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ‘পতিত’ হয়েছি। কিন্তু ‘মধ্যবিত্ত’ সম্পর্কে, ‘ভদ্রলোক’ সম্পর্কে আমার ছাত্রজীবনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পেশাজীবনের সুবিধা ভোগ করেও ইতিবাচক হয়নি। সব অর্থে আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দেয়ালে বন্দী। সুবিধাবাদ আমাকে ছুঁয়েছে, পরশ্রীকাতরতা আমাকে ক্লান্ত করেছে, আর ভদ্রলোক হয়ে ওঠার ব্যাকুল আকুতি আমার! মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পতিত হয়ে ত্যাগ করেছি আমার আত্মপরিচয়কে, বন্দী হয়েছি আপন সত্তার শৃঙ্খলে!
ভাই হানিফ মাহমুদ, মধ্যবিত্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মুক্ত করবে বটে; কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তার আত্মার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে কে?
মোয়াজ্জেম হোসেন
nilumoni13@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.