রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বেগ by আবুল কাশেম

পবিত্র রমজান মাস আসতে বেশি দিন বাকি নেই। কিন্তু এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সরকারও। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সরবরাহ ঠিক রাখতে ইতিমধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।


এসব বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলেছে, এ বছর রমজানে ভোজ্য তেলের সংকট দেখিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করা হতে পারে। গত রমজানে যেমনটি করা হয়েছে চিনির ক্ষেত্রে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও গত রমজানে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ক্রেতাদের ৬০ টাকার চিনি ৮০ টাকায় কিনতে বাধ্য করেছে ব্যবসায়ীরা। সরকারের উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ হলো, গত রমজানের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম এখনই বেশ চড়া। রমজানে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও চাঁদাবাজিও যেমন বাড়ে, তেমনি এসবের উছিলায় ব্যবসায়ীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বর্তমানের চড়া মূল্যের ওপরে প্রতিবারের মতো এবারের রমজানে আরো মূল্য যোগ হলে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠবে বলে আশঙ্কা সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অবশ্য দাম বৃদ্ধির কয়েকটি যৌক্তিক কারণের কথাও বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, সরবরাহ, মজুদ, মূল্য পরিস্থিতি ও বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা পর্যালোচনা সংক্রান্ত বৈঠকে বাণিজ্য সচিব মো. গোলাম হোসেন দাম বাড়ার পেছনে ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ব্যাংকের উচ্চ সুদের হারকে দায়ী করেছেন। প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দাম এখনো কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে বলেছেন, রমজান মাসেও যাতে মূল্যের বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে সে জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড জোরদার করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত রমজান মাসের তুলনায় বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনই অনেক চড়া। গত রমজানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ছিল ১০৯ থেকে ১১০ টাকা। এখন দাম ১১৮ থেকে ১২০ টাকা। আর গত রমজানে পাম অয়েলের দাম ছিল ৯৬ থেকে ৯৯ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকা। অবশ্য গত কয়েক দিনে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম লিটারে চার-পাঁচ টাকা কমেছে। তবে আমদানি কম হওয়ায় রমজানে ভোজ্যতেলের সংকটের আশঙ্কাও রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রমজান মাসে ভোজ্য তেলের চাহিদা এক লাখ ৭৫ হাজার টন। এখন মজুদের পরিমাণ এক লাখ ২১ হাজার টন। তবে আরো এক লাখ ৫৮ হাজার টন আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা আছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক ওই বৈঠকে বলেছেন, বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহে সমস্যা রয়েছে। আমদানিকারকরা ভোজ্য তেল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলছে না। এ কারণে রমজান মাসে সরবরাহ সংকট হতে পারে। তবে বাণিজ্য সচিব বলেছেন, সামগ্রিক বিবেচনায় ভোজ্য তেলের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা যায়। তা সত্ত্বেও মিল মালিকদের আরো বেশি ঋণপত্র খোলার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
রমজানে আরেক অত্যাবশকীয় পণ্য ছোলার বর্তমান দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি। গত রমজানে এর দাম ছিল ৬৬ থেকে ৯০ টাকা। সারা বছর যে পরিমাণ ছোলা বিক্রি হয়, তার চার ভাগের একভাগই বিক্রি হয় রমজান মাসে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রমজানে ছোলার দাম বেড়ে যায় প্রতিবারই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার ছোলার কোনো সংকট হবে না। বছরে ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে বিক্রি হয় ২৫ হাজার টন। দেশে এখন এক লাখ ৭৮ হাজার টন ছোলা রয়েছে। আরো ৩৫ হাজার টন আমদানির ঋণপত্র খোলা আছে।
গত রমজানের তুলনায় মসুর ডালের বর্তমান দামও বেশি। গত বছর আগস্টে রোজার সময় মানভেদে প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ছিল ৭২ থেকে ৯৫ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৫ থেকে ১১০ টাকা। ফলে রমজানে স্বস্তিতে 'ডাল-ভাত' খেতেও বেগ পেতে হবে গ্রাহকদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে রমজানের চাহিদার তুলনায় মসুর ডালের মজুদের পরিমাণ কম। তবে আমদানির জন্য ঋণপত্র আছে। সেসব আমদানি হলে সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। মন্ত্রণালয় বলছে, রমজান মাসে মসুর ডালের চাহিদা ৫০ হাজার টন। মজুদ আছে ৩৯ হাজার টন। তবে টিসিবির মাধ্যমে আরো ১৫ হাজার টন আমদানির প্রক্রিয়া চলছে।
আলু, লবণ ও ডিম সব পরিবারের জন্যই প্রয়োজনীয় পণ্য। মৌসুম ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গেই আলুর দাম বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি আলুর দাম ২০ থেকে ২২ টাকা। গতবার রমজানের সময় আলু ছিল ১৪-১৬ টাকা কেজি। এবার লবণের দাম যেন আকাশ ছুঁয়েছে। টিসিবির ১০ জুনের বাজার দর হিসাবে প্রতি কেজি লবণের দাম ১৮ থেকে ৩৫ টাকা। আর প্রতি হালি ডিমের দাম ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। তবে লবণ ও ডিম আমদানি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছে সরকার। পণ্য দুটি আমদানি হলে দাম কমবে বলে আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে খেজুর নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকছেই। কারণ, গত রমজান মাসে খেজুরের দাম ছিল ৬০ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত। সেই খেজুরের এখনকার দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রমজানের আগেই বিপুল পরিমাণ খেজুর আমদানি হবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই দাম কমবে। তবে পেঁয়াজ ও চিনির দাম গত রমজানের চেয়ে কম রয়েছে। দেশে এ দুটি পণ্যের মজুদও বেশ ভালো।
পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রমজানে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রেখে দাম সহনশীল পর্যায়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ উজ জামানের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আরেকটি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবার রমজানে ভোজ্য তেলের সংকটের আশঙ্কা করেছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওই আশঙ্কা আমলে নেয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা তাদের দায়িত্ব নয় বলে বৈঠকগুলোতে উল্লেখ করে বলেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মূলত ভোজ্য তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুরের সরবরাহ এবং বাজার পরিস্থিতি দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমদানির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। ব্যবসায়ীরা কোনো কারসাজি করে সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করছে কি না তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব গোয়েন্দা সংস্থার।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে এনএসআইকে নির্দেশ দিয়েছে। আর এ বছর রমজানে রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ও পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সক্রিয় থাকবে বলে গত বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.