স্বপ্নচারী এক চিকিৎসক by আনোয়ার ফরিদী

২৪ মার্চ সকাল ১০টার দিকে প্রগতি সরণির শেওড়াপাড়া এলাকার ব্যস্ত রাস্তার ধারে এক ভদ্রলোক পড়ে আছেন। এ সময় সেখান দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন মিরপুর ইউনিভার্সিটির বিবিএর ছাত্র মুস্তাক ও তার মামাতো বোন মাহমুদা আক্তার।


তারা রিকশা থেকে নেমে লোকটির কাছে গিয়ে দেখলেন, ভদ্রলোকের কান ও নাক দিয়ে অবিরল ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। দুই ভাইবোন দ্রুত তার পকেট হাতড়ে একটি পরিচয়পত্র খুঁজে পেলেন। তাতে লেখা ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম, সিনিয়র উপ-সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে মুস্তাক দেখলেন, লাস্ট কলটি গাজীপুরের এমপি মোজাম্মেল হকের। কললিস্টে খুঁজে পেলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবের নম্বর। সেই ভদ্রলোককে তারা বিস্তারিত জানালেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমে আল-হেলাল হাসপাতাল, তারপর সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দু'দিন পর খালেদের জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু আবারও জ্ঞান হারান তিনি এবং কান ও নাক দিয়ে রক্তপাত হতে থাকে। আবারও অপারেশন। অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করলে তাকে স্থানান্তর করা হয় অ্যাপোলো হাসপাতালে। চিকিৎসকদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে টানা ৪০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ৫ মে রাতে অজানালোকের উদ্দেশে পাড়ি জমান ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম। মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই নামে পরিচিত হলেও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ এবং সাংস্কৃতিক মহলে পোশাকি নামের বদলে ডলার নামেই তাকে সবাই চিনত। মূলত চিকিৎসক জগতের মানুষ হলেও ডলারের সার্বক্ষণিক বিচরণ ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
১৯৯১ সালে 'মোনালিসা' নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডলার। বইমেলায় একটি স্টলও নিয়েছিলেন। '৯৬ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অঙ্গ সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কমান্ডের ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আমাকে। এ সময় আমার সঙ্গে যুক্ত হন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ১৫তম ব্যাচের ছাত্র বর্তমান আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত ডা. মোশতাক আহমেদ ও লন্ডনে অবস্থানরত ডা. মাহামুদুর হাসান মামুন। হঠাৎ একদিন মোশতাকের সঙ্গে ডা. ডলার এসে উপস্থিত। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে 'অতন্দ্র একাত্তর' নামে একটি সংকলনের কাজ করছিলাম আমি। ডলারকে বললাম, 'স্বাধীনতা যুদ্ধে চিকিৎসকদের অবদান' এই শিরোনামে একটি লেখা দিতে। ডলার এককথায় রাজি। সাত দিনের মাথায় লেখা জমা দিলেন।
ডলার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। আমাকে বলতেন, একসময় বাংলাদেশের জেলায় জেলায় নার্সিং স্কুল হবে, কলেজ হবে, হাসপাতাল হবে_ সে জন্য বেশকিছু দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের মডেলও দেখে এসেছি সরকারের পক্ষ থেকে। মোদ্দা কথায়, ডলার ছিলেন এক স্বপ্নচারী মানুষ।
শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের 'অন্তরে রেস্তোরাঁয়' ডলার প্রায়ই আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারত। অন্তরের মালিক ইফতেখার হোসেনের সঙ্গেও আমার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল তার। ডলারের মৃত্যু সংবাদ শুনে ইফতেখার অত্যন্ত ব্যথিত। তার এই বেদনার প্রকাশ ঘটেছে বিএসএমএমইউর প্রধান ফটক, অন্তরে রেস্তোরাঁ এবং বিএমএ ভবনের সামনে ৩টি বিশাল ব্যানার স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম ডলারের অভাবিত মৃত্যু এক রহস্যই রয়ে গেল। তবে ডলার চির জাগরূক হয়ে থাকবেন তার পিতা-মাতা, স্ত্রী রুকসানা জেবা, ভাইবোন, সতীর্থ শুভাকাঙ্ক্ষী চিকিৎসকবৃন্দ এবং সাংস্কৃতিক মহলের নানা অঙ্গনের বন্ধু-বান্ধবের হৃদমন্দিরে।
anwarfaridec@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.