মুজিবনগর সরকার বিধিসম্মতভাবে গঠিত হয়েছিল by খন্দকার আসাদুজ্জামান

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশিত পথে। পরিচালনা করেছে মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ সরকার। সেই সরকারের প্রাণপুরুষ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সরকার গঠিত হয় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল।


একটি আধুনিক রাষ্ট্রের সরকারের যেসব উপাদান থাকা দরকার তার সবই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারে। ছিল মন্ত্রিপরিষদ, ছিল শক্তিশালী একটি সচিবালয়। মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রণা অনুযায়ী সচিবালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হতো গোটা সরকারব্যবস্থা। পরিচালিত হতো সশস্ত্র যুদ্ধ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সরকার সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, তা সর্বজনস্বীকৃত ও সত্য। সেই সরকারের একজন কর্মী হিসেবে তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মতো সেই কারণে আমারও অহংকার ১৯৭১, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক তথা বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সরকারের কাজগুলো এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে, যাতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, এখানে নিশ্চিতভাবে রয়েছে হোমওয়ার্কের ছোঁয়া। সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাই ধরা যাক। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা চূড়ান্ত আঘাত হানল বাংলাদেশে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ এবং যাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে গোটা দেশ পরিচালিত হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়ার সেনারা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে পাকিস্তানে। সেই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি যুদ্ধ পরিচালনার মতো দুরূহ কাজটি পরিচালিত হলো সুষ্ঠুভাবে। তা কি আগে থেকে পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব হয়েছে? আমরা যাঁরা মুজিবনগরে কাজ করেছি, যাঁরা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলাম, তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সূত্রটা কোথায়? কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থেকে মিলিটারি শাসনের অধীনে চাকরি করেও যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাঁদেরও অনুপ্রেরণা কোথায়? সিভিল সার্ভিসে কর্মরতদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হয়নি। কারণ তাঁরা দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তান সরকারের কাজ করলে তাঁদের কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু তার পরও তাঁরা চলে গেছেন মুজিবনগরে। কেউবা আবার সোজা যুদ্ধের মাঠে। দেশাত্মবোধ এবং স্বাধীনতা লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁরা যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধান। সময়টা অতি সামান্য। কারণ এই সময়ের মধ্যে দেশত্যাগ করতে হয়েছে নেতাদের। সবাই গিয়ে হাজির হয়েছেন একটি জায়গায়। যাঁকে কেন্দ্র করে মিলিত হয়েছেন তিনি তার আগেই সব ঠিক করে রাখলেন। সরকার গঠিত হলো মাত্র কয়েক দিনের মাথায়। সরকারের শপথ গ্রহণ হলো ১৭ এপ্রিল। সচিবালয় কাজ শুরু করে দিল। মন্ত্রিপরিষদ কাজ শুরু করে দিল। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশের সুবিধা পাওয়া গেল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা সীমান্ত খুলে দিল সঙ্গে সঙ্গে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের (প্রথম অবস্থায় রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠিত হয়নি। পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি জাতীয় কিছু পাকিস্তানপন্থী দল) অত্যাচারে টিকতে না পেরে দেশত্যাগী এক কোটি মানুষের মাথা গোঁজার ব্যবস্থাও করতে হলো। একটি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে অস্ত্র দরকার, তাও জোগাড় করতে হলো। বঙ্গবন্ধু বিনা প্রস্তুতিতে যুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে দেননি। তবে নিশ্চিতভাবে গোপনীয়তা মেনে চলা হয়েছে যৌক্তিক কারণেই। তবে যতদূর সম্ভব তিনি নির্দেশ দিয়েছেন প্রকাশ্যে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য যা যা করার তাই যেন করা হয়। এমনকি তিনি যদি হুকুম দিতে নাও পারেন তাতেও যেন অসুবিধা সৃষ্টি না হয়। প্রত্যেককে সেভাবে কাজ করার জন্য তিনি ৭ মার্চের ভাষণে পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আরাধ্য কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই কাজটি কী ছিল_তাও পরিষ্কার করে তিনি নির্দেশ করে দিয়েছেন। বলেছেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তার চেয়ে বড় নির্দেশনা সাধারণ্যে আর কী হতে পারে?
২২ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব হিসেবে যোগদান করি। প্রথমেই আমরা নেতাদের খুঁজে পাইনি। নিরাপত্তার কারণে তাঁদের সম্পর্কে কঠিন গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত আমরা গেলাম মুজিবনগরে। দেখা হলো তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে। দেখা হলো পাবনার ডিসি ও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের খানের সঙ্গে। তিনি ছিলেন জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাবেক কর্মকর্তা। পাবনায় ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগে তিনি জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাবনায় কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করে ইতিমধ্যে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। যাই হোক, তাজউদ্দীন আহমদকে সরকার সংগঠনের কথা বলার পর তিনি আমাদের নির্দেশ দিলেন, একটি কাঠামো রচনা করার জন্য। সেই সময়ের বেশ মজার একটি ঘটনা মনে পড়ে। সরকারে যোগ দিলাম, কিন্তু নিয়োগপত্রের প্রশ্ন এল। তিনি বললেন, নিয়োগপত্র টাইপ করে আনুন। পাশেই একজন টাইপিস্টের কাছ থেকে টাইপ করিয়ে আনা হলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে (কেউ কেউ তাঁকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করেন, এটা ঠিক নয়। তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। তেমনি কেউ মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারকে অস্থায়ী সরকার বলে উল্লেখ করেন। তাও উচিত নয়। কারণ সেই সরকার সম্পূর্ণ বিধিসম্মতভাবে গঠিত হয়েছিল। তা বাংলাদেশের প্রথম সরকার, অস্থায়ী সরকার নয়।) আমার নিয়োগপত্রে সই করলেন। মোহাম্মদ নুরুল কাদের সাহেবের নিয়োগপত্রটি দিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হাতে। বললেন, ঐতিহাসিক এই কাজে আপনার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আপনি সই করুন নুরুল কাদেরের নিয়োগপত্রে। পার্ক সার্কাস স্ট্রিটে হোসেন আলী সাহেবের অফিসে গেলাম আমরা। প্রথম অবস্থায় সেখানেই বসার ব্যবস্থা হলো। সেই সময় আমরা সরকারের একটা কাঠামো তৈরি করলাম।
এটা বলার কোনো কারণ নেই যে মুক্তিযুদ্ধটা শুধু ৯ মাসের কোনো ব্যাপার ছিল। এটা শুধু কারো ঘোষণা পাঠের ফসল নয়, এটা শুধুই ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণেরই ফসল। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে একটি ভাষণের ক্ষেত্র নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে জেল-জুলুম ভোগ করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় জেলে কাটাতে হয়েছে। তাঁকে একটি দীর্ঘ আন্দোলন পরিচালনা করতে হয়েছে। দেশের মানুষের কাছে তাঁর বক্তব্য, কর্মসূচি পেঁৗছে দিতে হয়েছে। মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সদস্যদের বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে তৈরি করেছিলেন। যেমন_স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারটি বলা যায়। তিনি এমনভাবে বিষয়টি নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ না থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ও প্রদর্শিত পথ বেয়ে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। সেই কাজটি করেছে মুজিবনগরে গঠিত সরকার। এটা মনে করা অসংগত হবে না যে তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি সব কিছু বলে গিয়েছিলেন। তাও আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পারি। সেই অনুযায়ীই কাজ করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এটি ছিল জনযুদ্ধ। সুতরাং শুরু থেকেই সেখানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি চোখে পড়ে। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি সেভাবেই দেখেছেন। পরিচালিত হয়েছে জনযুদ্ধ হিসেবে। সেই যুদ্ধের প্রধান পরিচালক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : সংসদ সদস্য এবং মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব

No comments

Powered by Blogger.