চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের দিনলিপি by তৌহিদা শিরোপা

ভোর থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয় আখতার সানজিদা কাসেমের। এ কাসেম অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার তিনি। সাধারণত সকাল পৌনে ছয়টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠেন এই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এরপর দুই ছেলে আহনাফ জারিফ রহমান ও আফরাজ জাসমির রহমানকে ঘুম থেকে তোলেন।


ছেলেদের স্কুলের জন্য তৈরি করতে করতে নিজেও তৈরি হয়ে নেন। পরিবারের সবার সঙ্গে বসে নাশতা করেন। বড় ছেলেকে তাঁর স্বামী মোস্তাকুর রহমান পৌঁছে দেন স্কুলে। আর প্লে গ্রুপে পড়ুয়া ছোট ছেলে আফরাজকে সকাল আটটার মধ্যে সানজিদা কাসেম নিজেই স্কুলে নিয়ে যান। ‘আমার ছোট ছেলেটা আগে প্রায়ই অসুস্থ থাকত। স্কুল থেকে ফোন আসত। তাই এখন ওর ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্কুলের সামনেই অপেক্ষা করি। সেখানে ল্যাপটপে বসে কাজ করি। সাধারণত ওকে স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অফিসে আসি। তবে বিশেষ কোনো মিটিং থাকলে ওকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সরাসরি অফিসে আসি। মাঝেমধ্যে আফরাজ আমার সঙ্গে থাকার জন্য ভীষণ আবদার করে। ওকে বুঝিয়ে তবেই অফিসে আসতে হয়। মায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার জন্যই নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি। আমি যতক্ষণ বাসায় না থাকি, তিনি এসে ওদের দেখভাল করেন। আমার আর মায়ের ফ্ল্যাট একই অ্যাপার্টমেন্টে হওয়ায় এই সুবিধা পাচ্ছি।’
‘দিনের বেশি সময় কাটে অফিসে। আমাদের ফার্মে আটজন পার্টনার থাকায় একেকজন একেক দায়িত্ব বুঝে নেন। নানা ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট ভাগ করা থাকে। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করি। এ ছাড়া বিভিন্ন রিপোর্ট দেখা, অডিটের কাজ পর্যালোচনা করাও প্রতিদিনের কাজের মধ্যে পড়ে। অনেক ছেলেমেয়ে এখানে পড়তে আসে, শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে। তাদের সব ধরনের কাগজপত্রের ফাইল দেখার কাজ দিনেরটা দিনেই সেরে ফেলি। কোনো কোনো দিন কর্মশালা, আলোচনা সভা থাকে। সেখানেও অংশ নিতে হয়। পাশাপাশি পুলিশ স্টাফ কলেজে পার্টটাইম শিক্ষকতার কাজ করি। অফিসের কাজ সেরে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে বাসায় চলে যাই। এরপর পুরো সময়ই পরিবারের জন্য বরাদ্দ। সন্তানদের লেখাপড়া তদারক করি। বাসায় কোনো কাজ থাকলে সেরে ফেলি। সন্তানদের সঙ্গে বসে টিভি দেখি। রাতে খাওয়ার পর ওরা ঘুমিয়ে যায়। এরপর নিজেকে একটু সময় দিই। ভীষণ বই পড়ার অভ্যাস আমার। প্রতিরাতেই বই পড়া হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই ভালো লাগে। এ ছাড়া আত্মজীবনীও পড়তে পছন্দ করি। পরের দিনের কাজের পরিকল্পনা করে বারোটা-একটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবেই শেষ হয় একেকটি কর্মব্যস্ত দিন।’

যেভাবে হয়ে ওঠা
আখতার সানজিদা কাসেমের বাবা আবুল কাসেম ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস (আইসিএবি) অব বাংলাদেশের প্রথম সভাপতি। সানজিদা কাসেম তখন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অগ্রণী স্কুলে পড়ার সময় ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান বিভাগে পড়বেন। কিন্তু বাবার অসুস্থতার সময় ভাবেন, বাবার ব্যবসার হাল তাঁকেই ধরতে হবে। বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন। ইউনিভার্সিটি অব উইমেন ফেডারেশন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে আইসিএমএতে ভর্তি হন। এরই মাঝে চলতে থাকে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে বিকম পড়া। স্নাতক শেষে আইসিএবিতে পড়া শুরু করেন। ‘সব সফলতার পেছনেই হয়তো একটা কষ্টকর অভিজ্ঞতা থাকে। আমারও আছে। আমার সিএমএ পরীক্ষার তখন একটি কোর্স বাকি। এর চার দিন আগে বাবা মারা যান। দেখে যেতে পারেননি তিনি আমার সফলতা। এরপর এক বছরের জন্য সিঙ্গাপুরে যাই চাকরি নিয়ে। দেশে ফিরে এ কাসেম অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসে যোগ দিই। এর মধ্যে বিয়েও হয়। আমার স্বামী একজন সিএমএ। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি ও স্বামীর খুব সমর্থন-অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এটা না পেলে নারীর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আরেকটি কথা, অবশ্যই নারীকে তার লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সে অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। আর আমাদের পেশার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। পরিকল্পনামতো কাজ করলে সফলতা আসবেই।’

No comments

Powered by Blogger.