বাংলাদেশে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের নতুন অবস্থা by বদরুদ্দীন উমর

ব্রিটেনের সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভিবারি ৮ ফেব্রুয়ারি হাউস অব লর্ডস-এ বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর এক আলোচনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সেই সভায় লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কতিপয় নেতা উপস্থিত ছিলেন।
লর্ড অ্যাভিবারি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জেলে আটক অবস্থায় নির্যাতন এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে এক্ষেত্রে দায়মুক্ত রাখার বিষয়কে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া ছাত্রলীগের নানা ধরনের সহিংসতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, সরকারি দলের লোকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রত্যাহার করিয়ে নেয়া এবং বিরোধী দলীয় লোকদের একই ধরনের মামলা ঝুলিয়ে রাখার কথাও তিনি তার বক্তৃতায় বলেন। দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুদককে তার ভূমিকা পালন করা থেকে সরকারিভাবে বিরত রাখার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, যে সরকার আইনের শাসন বলবত্ রাখার কথা বলে তাদের দ্বারা কীভাবে এসব সম্ভব হয় এটা তার বোধগম্য নয়। (উধরষু ঝঃধত্ ১০.২.২০১০)
বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতির যে দিকগুলোর ওপরে ব্রিটিশ সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন, সেগুলো এখন দেশের বাইরে, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী অঙ্গনেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এ সমস্যা ও সঙ্কট অজানা নয়। এখানকার বিভিন্ন মহলে ও পত্রপত্রিকায় এসব বিষয়ে অনেক আলোচনা আগে থেকেই হয়ে আসছে এবং এখনও হচ্ছে। ছাত্রদের দ্বারা হলে বিশৃঙ্খলা এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দলগুলোর দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতি। টাকা-পয়সা নিয়ে ছাত্র ভর্তি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সব থেকে বিপজ্জনক দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারণ।
এই সঙ্গে এখন আবার নতুন উদ্যোগে শুরু হয়েছে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীদের তত্পরতা। তাদের রগ কাটার ও নরহত্যার পূর্বপ্রক্রিয়া যেভাবে এখন আবার দেখা যাচ্ছে, এটা পরিস্থিতিকে যে আরও জটিল ও মারাত্মক করবে এতে সন্দেহ নেই। ধর্মের জিগির তুলে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী তত্পরতা আশির দশক থেকে শুরু হয়ে এ দেশে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে কি দুর্যোগ সৃষ্টি করেছিল এটা এক পরিচিত ব্যাপার। এখন ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাস যুক্ত হয়ে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এর পরিণতি কিছুদিনের মধ্যে কি হবে তার চিন্তাও এক আতঙ্কের ব্যাপার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির তাদের রগ কাটা অভিযান শুরু করেই ক্ষান্ত নেই, তারা হত্যাকাণ্ডও শুরু করেছে। তাদের এই হত্যাকাণ্ড যে কত নির্মম ও ক্রিমিনাল এটা ফারুক হোসেন নামে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে হত্যা করে তার মৃতদেহ হলের সেফটি ট্যাঙ্কের মধ্যে ফেলে দেয়া থেকেই বোঝা যায়। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী নামে ইসলামের ধ্বজাধারী দলটির নেতৃত্বের টু শব্দ পর্যন্ত নেই। আওয়ামী লীগ যেমন তাদের ছাত্র সংগঠনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, সেভাবে জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্রদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে—এমন বলা যায় না। কারণ, আওয়ামী নেতৃত্বের একাংশ ছাত্রলীগের এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এবং তাদের উস্কানিদাতা হলেও তাদের উচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যখন এর বিরুদ্ধে কিছু কথা হচ্ছে তখন জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় অথবা জাতীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তাদের ছাত্র সংগঠনের এই নিষ্ঠুর বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। এটা নতুন নয়। জামায়াতে ইসলামী আগেও কোনোদিন তাদের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী তত্পরতার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। ছাত্রশিবিরকে তারা এর বিরুদ্ধে কোনো হুশিয়ারি দেয়নি। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা নয়, ধর্মের ধ্বজাধারীরা, বিশেষ করে তাদের নেতা জামায়াতে ইসলামীই বাংলাদেশে এখন ইসলামের নাম কলঙ্কিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখছে। তাদের এই ভূমিকার কোনো সমালোচনা ও পর্যালোচনা যে তাদের দলের অভ্যন্তরে কোথাও আছে, তার কোনো চিহ্ন ও প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। উপরন্তু এ ব্যাপারে তাদের নীরবতাকে তাদের সম্মতির লক্ষণ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? এ সবেরই পেছনে আছে ক্ষমতালিপ্সা, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা অধিকার বা ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা এবং আর্থিক থেকে নিয়ে সকল সম্ভাব্য প্রকারের দুর্নীতি। দুর্নীতিই আজ বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী, শুধু শাসক শ্রেণী নয়, সমগ্র সমাজকেই কুরে কুরে খাচ্ছে এবং দুর্নীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার এই দুর্নীতি যেভাবে চালিয়ে যাচ্ছে সেটা আগের রেকর্ড উত্তীর্ণ হয়েছে। এই দুর্নীতির সব থেকে বড় দিক হলো, তাদের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা সরকারি ক্ষমতার জোরে উঠিয়ে নেয়া এবং বিরোধী পক্ষের একই ধরনের দুর্নীতির মামলাগুলো উঠিয়ে না নিয়ে ঝুলিয়ে রাখা, যে বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতাও তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন।
আদালতকে হুকুম দিয়ে নিজেদের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েই যে এই দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রীরা পূতপবিত্র হয়ে জনগণের চিন্তায় শুধু মন্ত্র হিসেবে গৃহীত হয়েছেন এমন নয়। জনগণ তাদের দুর্নীতিবাজ, চোর, ঘুষখোর হিসেবেই জানে। বিশেষত, এ কারণে যে তাদের এই দুর্নীতি বন্ধ না হয়ে, বা কমে না এসে, এখন ক্ষমতার জোরে পুরো দমে চলছে। সেটা যদি না চলত তাহলে তাদের ছাত্র সংগঠন এমন উন্মত্ত হয়ে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে নিযুক্ত থাকত না। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রেরণা তারা ওপরতলা থেকেই পেয়ে থাকে। এদিক দিয়ে তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও পিছিয়ে নেই।
৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফেনীর চিহ্নিত ও দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল জয়নাল হাজারীর আত্মজীবনীর মোড়ক উন্মোচন করেছেন আওয়ামী লীগের এক উচ্চপর্যায়ের বাঘা বুদ্ধিজীবী। এই উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি ঘোষণা করেছেন, জয়নাল হাজারী কোনো সন্ত্রাসী নয়। তাকে চক্রান্তমূলকভাবে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এই জয়নাল হাজারী এমন এক প্রচণ্ড ও ঘৃণিত সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ যে, খোদ তার দল আওয়ামী লীগ সাধু-সন্তদের সংগঠন না হলেও, তাকে দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে রাখতে এখনও পর্যন্ত রাজি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কাছে তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনকারীর জোরালো সুপারিশ হলো জয়নাল হাজারীকে সাধু হিসেবে ঘোষণা করে দলে অন্তর্ভুক্ত করার! একটি দেশে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি তো এমনিতেই রাজত্ব করে না। শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দল ও তাদের রক্ষিত বুদ্ধিজীবীরাও যখন এভাবে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে তার পক্ষে নোংরা ওকালতি করে তখন বোঝা যায়, দেশটিতে সর্বনাশ যে কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত এবং কত গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
১৯৭২ সাল থেকে গড়ে ওঠা এই দুর্নীতিবাজ ও প্রতারক শাসক শ্রেণীর কবলে বাংলাদেশের জনগণ এখন জিম্মিতে পরিণত হয়েছেন। এদের প্রধান দলগুলোর মধ্যে একপক্ষ ধর্মের এবং অন্যপক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতার শোরগোল তুলে রাজনীতি করলেও তারা হলো, এই অভিন্ন শাসকশ্রেণীরই লোক। এদের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া জনগণের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই।

No comments

Powered by Blogger.