চারদিক-নতুন বছর, নতুন রাষ্ট্রপতি by জাবেদ সুলতান

এ প্রথা ১৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো। প্রতিবছর ১ জানুয়ারি নতুন একজন রাষ্ট্রপতি এক বছরের জন্য দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮৪৮ সালে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা গঠনের পর থেকে সুইজারল্যান্ডে এ নিয়ম চলে আসছে। সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নেতৃত্ব থাকে সাতজনের একটি উপদেষ্টা (কাউন্সেলর) পরিষদের ওপর। বলা হয়ে থাকে, এই উপদেষ্টাদের সাতজনই যৌথভাবে দেশের প্রধান নির্বাহী।


তবে বাইরের দেশে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সময় কিংবা এই উপদেষ্টারাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হয়ে থাকে, যিনি বাকি ছয় উপদেষ্টাকে নিয়ে সরকার পরিচালনা করেন। সংবিধানমতে, রাষ্ট্রপতিই দেশটির সর্বোচ্চ পদাধিকারী। প্রত্যেক উপদেষ্টাই সরকারের একটি বিভাগের দায়িত্বে থাকেন এবং অন্যান্য দেশের একজন মন্ত্রীর মতো ওই বিভাগ পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিবছর এই উপদেষ্টারাই একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। প্রথাগতভাবে এক বছরের উপরাষ্ট্রপতি সাধারণত পরের বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।
সুইজারল্যান্ডের উপদেষ্টাদের জীবনযাপন খুবই সাধারণ। রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য উপদেষ্টাদের রাষ্ট্রীয় বাসভবন নেই। রাজধানী বার্নে যাঁদের নিজের বাড়ি নেই, তাঁদের থাকতে হয় ভাড়াবাড়ি কিংবা হোটেলে। বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা তো প্রতিদিন জুরিখ থেকে সাধারণ ট্রেনে করে বার্নে এসে অফিস করেন এবং দিনশেষে আবার জুরিখে ফিরে যান। নেহাত প্রয়োজন না হলে তাঁদের নিরাপত্তায় কোনো বাহিনীও কাজ করে না। উপদেষ্টারা তো বটেই, খোদ রাষ্ট্রপতিও চলাফেরা করেন সাধারণভাবে, কোনো ধরনের প্রোটোকল ছাড়া। পথে ও পাশের রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেতে আসা রাষ্ট্রপতিকে দেখে খুব অবাক হওয়ারও নেই সে দেশে। বিশ্বের দ্বিতীয় পুরোনো এই ফেডারেল সরকারব্যবস্থার সুইজারল্যান্ডকে তাই হয়তো সভ্য সমাজের উদাহরণ হিসেবে নেওয়া হয় অনেক সময়।
সুইস ফেডারেল সরকারের উপদেষ্টারা চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন দেশটির দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সব সদস্যের ভোটে। তবে মজার ব্যাপার হলো, অন্যান্য দেশে যেমন একই সঙ্গে পুরো সরকার নির্বাচিত হয়, সুইজারল্যান্ডে এমনটা হয় না। এখানে ঠিক চার বছরের জন্য একেকজন উপদেষ্টা নির্বাচিত হন আসন খালি হওয়ার ভিত্তিতে। তবে চার বছর পর পরবর্তী মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বে থাকার সময় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, এমনকি নিজের ব্যবসা থেকেও বিরতি নিতে হয় তাঁদের। বিশ্বের অন্যতম ধনী এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের বেতন বছরে দুই লাখ ৫৬ হাজার ইউরোর সমমান চার লাখ সুইস ফ্রাঁ। চার বছর মেয়াদের মধ্যে উপদেষ্টারা বেশ স্থায়ীভাবে দায়িত্বে থাকেন। সাধারণ অনাস্থা পোষণ করেও সাংসদেরা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারেন না। ১৫০ বছরে বিশেষ ঘটনার কারণে এমন মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘটনা ঘটেছে মাত্র চারবার। আর বিশ্বের বিশেষ করে এশীয় রাজনৈতিক চরিত্রের মতো নির্বাচনে অনাস্থার ঘটনাও বিরল সুইজারল্যান্ডে। ১৫০ বছর ধরেই সব ধরনের নির্বাচনের রায় মেনে নিচ্ছেন প্রার্থীরা। সুইজারল্যান্ড হচ্ছে সরাসরি গণতন্ত্রের দেশ। সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদের, এমনকি উপদেষ্টাদের যেকোনো সিদ্ধান্তে যেকোনো সময় কারণ দর্শানোর অধিকার রাখে প্রত্যেক নাগরিক। শুধু কথায় নয়, জবাবদিহির এ বিষয়টি আসলেই কার্যকর সুইজারল্যান্ডে।
প্রতিবছরের মতো ১ জানুয়ারিতেও দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন রাষ্ট্রপতি। গত বছরের উপরাষ্ট্রপতি মিশলিন কাল মিরে ২০১১ সালের জন্য সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে ২০১০ সালের রাষ্ট্রপতি ডোরিস লিওথার্ড ফিরে গেছেন উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর নিয়মিত দায়িত্বে। মিশলিন কাল মিরে উপদেষ্টা হয়েছিলেন ২০০২ সালের ৪ ডিসেম্বর। ২০০৩ সাল থেকে তিনি সুইজারল্যান্ড সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।
সাতজন উপদেষ্টা এবং তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে এক বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার প্রথাটি চলে আসছে ১৮৪৮ সালের নতুন সংবিধান রচনার পর থেকে। ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ সালে দেশব্যাপী বেসামরিক যুদ্ধ ও অন্যান্য রাজনৈতিক অস্থিরতার পর সুইজারল্যান্ডবাসী সেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন অনুভব করেন। সেই ঐক্যের ফলই আধুনিক সুইজারল্যান্ডের বর্তমান সংবিধান। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি নির্বাচনের প্রথাও তখন থেকেই চালু রয়েছে। এর মধ্যে অনেক এগিয়েছে সুইজারল্যান্ড, পরিবর্তন এসেছে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থায়। কিন্তু বদলায়নি ১৫০ বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এই পরম্পরা। দেশের সংবিধান আর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি এমন আনুগত্যই হয়তো আজকের উন্নত সুইজারল্যান্ডের ভিত্তি।

No comments

Powered by Blogger.