দূর দেশ-ঐক্যবদ্ধ লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা by আলী রীয়াজ

লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসনের অবসান হতে চলেছে, এমনটা বলাই যৌক্তিক। দেশের একটা বড় অংশই যে কেবল তাঁর বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা নয়; রাজধানী ত্রিপোলি ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতেও এখন রক্তাক্ত সংঘর্ষ চলছে। যেকোনো সময় রাজধানীও বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করাই সংগত।


কিন্তু রক্তাক্ত সংঘাত ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে কেবল একজন দুঃশাসকেরই পতন ঘটছে না, সম্ভবত একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়ারও অবসান ঘটছে।
প্রায় ৬০ বছর আগে ১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইউনাইটেড কিংডম অব লিবিয়া নামে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল, ২০১১ সালে আমরা কি তার জীবনাবসান প্রত্যক্ষ করছি? গণতন্ত্রকামী ও পরিবর্তনাকাঙ্ক্ষী সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ভাড়াটে হত্যাকারীদের লেলিয়ে দিয়ে গাদ্দাফি কেবল যে তাঁর শাসনের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন তা নয়, তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যে লিবিয়ার আশু ও দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ এখন বিপদাপন্ন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক লুটেরা শাসনব্যবস্থা তৈরি করে কঠোর হাতে দেশ শাসনের মাধ্যমে লিবিয়ায় গাদ্দাফি তাঁর পরিবার ও তাঁবেদার সুবিধাভোগীরা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা বা শক্তি তৈরি হতে দেয়নি। উত্তর আফ্রিকার অন্য দুটি দেশে গত কয়েক মাসে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুতির সময় এমন আশঙ্কা তৈরি হয়নি। কারণ, সেখানকার স্বৈরাচারী শাসকেরা কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার মাধ্যমে তাঁদের দুঃশাসনকে বহাল রেখেছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে সেনাবাহিনী অন্যতম, শাসকদের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিলে বেন আলী ও মোবারকের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তিউনিসিয়া ও মিসরে ওই সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল বলেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন হয়নি।
অন্যদিকে লিবিয়ায় ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই মুয়াম্মার গাদ্দাফি একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা নিলেও গাদ্দাফি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে দেননি। বরং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী ও স্পেশাল ব্রিগেড নামে যেসব আধাসামরিক বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো গাদ্দাফি, তাঁর পরিবার কিংবা তথাকথিত বিপ্লবী কমিটির প্রতি অনুগত ও তাদের কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য। এসব বাহিনী রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, তাদের স্বার্থও এই রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত নয়।
সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীগুলোর বাইরে গত ৪১ বছরের শাসনের সুবিধাভোগীরা হচ্ছেন তাঁর উপজাতি বা ট্রাইবের সদস্যরা। এই উপজাতি গোষ্ঠীগুলো লিবিয়ায় আছে রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়ার উদ্ভবের হাজার হাজার বছর আগে থেকে। লিবিয়ায় কমপক্ষে ১৪০টি উপজাতি রয়েছে। তাদের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে না। দেশের সবচেয়ে বড় উপজাতি ওয়াকাল্লা। তারা গাদ্দাফির সঙ্গে সহযোগিতা করলেও পশ্চিমাঞ্চলের এই উপজাতিটি কখনোই গাদ্দাফি উপজাতিকে তাদের চেয়ে শ্রেয় বলে মনে করেনি। দেশের পূর্বাঞ্চলের জুওয়ায়া উপজাতি গাদ্দাফির শাসনের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাঘারিহা উপজাতি শেষ পর্যন্ত কার পক্ষে যাবে, তা বলা মুশকিল। এখন অনেক উপজাতি গোষ্ঠীর সময় এসেছে প্রতিশোধ নেওয়ার। গাদ্দাফি তাঁর শাসনের প্রথম ১১ বছর উপজাতিগুলোর প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা করলেও ১৯৮০ সালে তাঁর নীতিতে পরিবর্তন এনে এই উপজাতিগুলোকে ক্ষমতাবান করে তুলেছেন। আরব বিশ্ব নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকের মতে লিবিয়া হচ্ছে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি উপজাতি-বিভক্ত দেশ।
উপজাতি বিভক্তির একটি আঞ্চলিক রূপও রয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চল বেনগাজি বন্দরনগর যেখানে অবস্থিত—গাদ্দাফির শাসনের সময়ে কেবল উপেক্ষিতই হয়েছে তা নয়, কার্যত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের ছয়টি তেল রপ্তানি সুবিধাসমৃদ্ধ নৌবন্দরের পাঁচটিই এখানে, দেশের অধিকাংশ তেলক্ষেত্র হচ্ছে এই এলাকায়। তিনটি প্রধান তেল শোধনাগার বেনগাজির কাছাকাছি। দেশের একমাত্র তরলীকৃত গ্যাস প্লান্টও এখানে, অথচ দেশের পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি, শিক্ষা ও চিকিৎসা-সুবিধাবঞ্চিত এখানকার মানুষ। এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছে বেনগাজিতে। ৪১ বছর ধরে মাঝেমধ্যে যে বিক্ষোভ হয়েছে, তার কেন্দ্র ছিল বেনগাজি। লিবিয়ার ইতিহাস যাঁরা জানেন অথবা ১৯৮১ সালের লায়ন অব ডেজার্ট নামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের স্মরণে থাকবে ইতালির ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ওমর আল মুখতারের সাহসী প্রতিরোধের কথা। এও অনেকের জানা আছে যে এই পূর্বাঞ্চলেই রাজা ইদ্রিস আল সানুসির রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। রাজা ইদ্রিস ১৯৫১ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন গাদ্দাফি। পূর্বাঞ্চলের অনেকেই এ ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন তাঁদের উত্তরসূরিদের।
উপজাতি ও আঞ্চলিক বিভেদই কেবল ভবিষ্যতে লিবিয়ার ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রশ্নকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে না; প্রশ্নটি উঠছে এ কারণেও যে দেশের প্রধান তিনটি অঞ্চল—কাইরিনিইকি, ত্রিপোলিতানিয়া ও ফেজানকে একত্র করে একটি রাষ্ট্র তৈরি করে জাতিসংঘ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। গত ৭০ বছরে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, বৈবাহিক সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযোগ তাদের পার্থক্য অনেকটাই কমিয়েছে। কিন্তু এ কথা মনে করার কারণ নেই যে তা সম্পূর্ণ অপসারিত হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর গোটা দেশটি যেভাবে খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে, তা থেকেও অনেকেরই ধারণা, দীর্ঘদিন একত্রে থাকলেই ভবিষ্যতে একত্র থাকার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় না। লিবিয়া খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়তে পারে এবং এ ধরনের আশঙ্কা সত্যি হতে গেলে দেশটি যে ভয়াবহ রকম রক্তপাতের মধ্য দিয়ে যাবে, তা বলার অর্থ এই নয় যে, তার চেয়ে গাদ্দাফির অমানবিক দুঃশাসনই ভালো ছিল। ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক গাদ্দাফি শাসন আজ হোক কাল হোক অবসান হতোই—লিবিয়ার মানুষের ন্যূনতম মানবিক অধিকার ও সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আর কোনো উপায় ছিল না।
গাদ্দাফি ও তাঁর মতো শাসকদের ক্ষমতার কাছেধারে রেখে মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। লিবিয়ার সাধারণ মানুষ এত নিষ্পেষণের পরও অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন রকম আশঙ্কা সত্ত্বেও লিবিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো একটি অখণ্ড লিবিয়ার কোনো বিকল্প চিন্তা তৈরি হয়নি। যার সবচেয়ে প্রমাণ হলো বেনগাজি থেকে শুরু করে যেখানেই প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে, সেখানেই দেশের পুরোনো জাতীয় পতাকা নিয়ে মানুষ পথে নেমেছে। দেশের ১৯৫১ সালের সংবিধান, যা গাদ্দাফি ১৯৬৯ সালে স্থগিত করেন, তার পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে এই ঐক্য রক্ষা সম্ভব। কিন্তু এ সবকিছুরই পূর্বশর্ত হচ্ছে গাদ্দাফি-সমর্থক ও তাঁর ভাড়াটে বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে একটি বিকল্প কাঠামো তৈরি হওয়া। যেসব শহরে বিক্ষোভকারীরা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে একধরনের প্রশাসন তৈরি হচ্ছে; কিন্তু সংঘাত প্রলম্বিত হলে তা ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। তদুপরি গাদ্দাফির পতনের পর বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে কি না, সেটাও নির্ধারণ করবে লিবিয়া ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে কি না।
লিবিয়ায় সংঘাত ও সংঘর্ষ যদি প্রলম্বিত হয়, তবে বাইরের শক্তি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তিউনিসিয়া ও মিসরের শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের সাফল্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসবাদের প্রবক্তাদের জন্য একটা বড় ধরনের পরাজয়, তা বলাই বাহুল্য। ওই গোষ্ঠীগুলো লিবিয়ার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করতেই পারে।
এসব কারণেই অনেকের মতো আমার মনেও ঐক্যবদ্ধ লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা। সেই শঙ্কা ভিত্তিহীন কি না, দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হলে আনন্দিতই হব।
ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.