মন্ত্রীদের তালগোল পাকানো কথাবার্তাঃ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়েই চলেছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তৃপ্তি সহকারে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বললেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এজন্য জীবন বাজি রাখার কথা বলেছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর এমন মরিয়া মন্তব্যই প্রমাণ করে পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়, বরং গুরুতর।

দেশজুড়ে খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে দেশের প্রধান দুই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনা পরিস্থিতি যেন উস্কে দিয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীর বুকে এক ওয়ার্ড কমিশনার, চাল ব্যবসায়ী ও বৃদ্ধাকে খুন করে সন্ত্রাসীরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য বলে জাহির করেছে। পরদিনই ঢাকার কেরানীগঞ্জ, পাবনা ও কুষ্টিয়ায় ছয় খুনের ঘটনাই প্রমাণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা অসহায়! কিন্তু তারপরও মন্ত্রীদের মুখে একই বুলি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একধাপ এগিয়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ভালো বলে দাবি করেছেন। তবে তার এ আত্মতৃপ্তি মোটেই স্থায়ী হয়নি। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, জীবন দিয়ে হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা হবে। বড় তালগোল পাকানো কথাবার্তা! পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে জীবন বাজি রাখার প্রশ্ন উঠবে কেন?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতভর বিবদমান ছাত্র ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ এবং ছাত্র খুনের সময় কর্তব্যরত পুলিশের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগ এই সরকারের আমলে নতুন না হলেও এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মন্ত্রীর নির্দেশ শিরোধার্য। যে বা যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ মানবে না, তাদের এর খেসারত দিতে হবে। মন্ত্রীদের এ ধরনের হুমকি-ধমকি মোটেই স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি’তে মহাশক্তিধর মহাজোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এমন কথা মানায় না। তবে বাস্তবতা মেনে নিলে এ কথা বলার সুযোগ থাকত না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এমন কথা বলা দোষের নয়। অর্থাত্ প্রকারান্তরে মন্ত্রী স্বীকার করে নিয়েছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আসলেই ভালো নয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পর থেকেই দেশের পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সরকারদলীয় নেতাকর্মী, বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সংগঠনের ক্যাডারদের ক্ষমতার দাপটের সামনে পুলিশ প্রশাসনকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল। সরকার যেখানে সবকিছুর ঊর্ধ্বে দলকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা কী করবেন সেটা বলে দিতে হয় না। তাই সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলার মুখে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের এমন ভূমিকার অভিযোগ কারও কাছে পাত্তা না পাওয়ায় বিরোধী দলে ক্ষোভ বাড়লেও ক্ষমতাসীনরা গা করেনি। রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রী নেতা সানিকে কুপিয়ে হত্যার সময়ও পুলিশ ছিল নীরব। এ নিয়ে শরিক দলের স্থানীয় এমপিকেও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্র খুনের ঘটনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল খুবই অস্বাভাবিক ও হতাশাজনক। সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষে ছাত্রলীগ নেতা নিহত হওয়াতেই সম্ভবত তার টনক নড়েছে। তিনিও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে হামলাকারীদের নির্মূলে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। একে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে নিশ্চয়ই এমনসব কথা বলার প্রয়োজন হতো না।
গণতান্ত্রিক সরকার শুধু দল নিয়েই ব্যস্ত থাকে না। দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থই সেখানে প্রাধান্য পায়। এর ব্যত্যয় ঘটলে তার পরিণতি কী হয় সেটা এদেশে বারবার দেখা গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ যে স্বাভাবিক নয়, সেটা সরকারের সামগ্রিক কাজ ও মন্ত্রীদের কথাবার্তা থেকে অনুমান করা কঠিন নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতির পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা ক্ষমতাসীনদের অস্বাভাবিকতারই প্রমাণ। এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন সবার কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.