চারদিক-আসুন, এখনই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করি by অরূপ রতন চৌধুরী

ডায়াবেটিস একটি জীবনব্যাপী রোগ। একে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা সম্ভব। পাশাপাশি যাঁদের এখনো ডায়াবেটিস হয়নি, তাঁদের এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশনের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৩ কোটি এবং প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন।


পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিসের রোগীর মৃত্যু হয় এবং দুজন নতুন ডায়াবেটিসের রোগী শনাক্ত হয়; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের দেওয়া এই সাম্প্রতিক তথ্য আমাদের চমকে দেয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ে। এই দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, ডায়াবেটিসের লক্ষণ, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ২০০৩ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৯ কোটি ৪০ লাখ। গত তিন বছরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় চার কোটি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০ বছরে বিশ্বে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৫ কোটি।
বর্তমানে নগরায়ণ ও এর ফলে পরিবর্তিত জীবন যাপনের কারণে সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃদ্ধির এই হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে বেশি। টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে—১. কায়িক পরিশ্রম না করা। ২. মোটা বা স্থূলকায় হয়ে যাওয়া। ৩. অতিমাত্রায় ফাস্টফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় (সফট ড্রিংকস) পান করা। ৪. অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকা। ৫. ধূমপান ও তামাক। ৬. গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যা।
এ ছাড়া যাঁদের মা-বাবা অথবা রক্তের সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে এবং যাঁদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি, তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায়
উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মেদ ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম কারণ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অথচ উপসর্গহীনতা বা অসচেতনতার কারণে ৫০ শতাংশ রোগীই জানেন না যে তাঁদের ডায়াবেটিস আছে। কিডনির অক্ষমতা বা কিডনি বৈকল্যের মুখ্য কারণ ডায়াবেটিস, অন্ধত্ব ও দৃষ্টিবিচ্যুতির প্রধান কারণ ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যয়ভারই একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার ৫ থেকে ১০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায় বলে অনুমান করা যায়।
বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি করে পা কাটা যাচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত কারণে। আবার যত পা কেটে ফেলতে হচ্ছে, এর ৮৫ শতাংশের প্রধান কারণ অসচেতনতা। যথাযথ যত্ন, শিক্ষা ও সচেতনতাই এ সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে। ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ ডা. মো. ইব্রাহিমের ছিল দূরদৃষ্টি। আজ তাঁরই সৃষ্টি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বাংলাদেশে অগণিত ডায়াবেটিসের রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছে।

ডায়াবেটিস কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
অনেক দিন ধরে বিভিন্ন গবেষণা করে দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস বহুলাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে মেদভুঁড়ি যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুতভাবে হাঁটতে হবে।
ক্যালরিবহুল খাবার যেমন: তেল-চর্বিযুক্ত খাবার (তেল, ঘি, মাখন, ডালডা, চর্বি, ডিমের কুসুম, মগজ ইত্যাদি) কম খেতে হবে।
চিনি, মিষ্টিযুক্ত খাবার (সফট ড্রিংক, চকলেট, কেক, পেস্ট্রি, কুকি ইত্যাদি) কম খেতে হবে।
ফাস্টফুড কম খেতে হবে।
শর্করাবহুল খাবারগুলো (চাল, আটা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাবার) কিছুটা হিসাব করে খেতে হবে।
শাকসবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে।
মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
গর্ভকালীন মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে যেন গর্ভস্থ শিশু অপুষ্টিতে না ভোগে।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে আজকাল টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। তাই এরা যেন অপুষ্টিতে না ভোগে, আবার অতিপুষ্টিতে ওজন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে শিশুরা যেন শ্রমবিমুখ না হয়, তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
ধূমপানসহ সব ধরনের তামাক বর্জন করতে হবে।
ডায়াবেটিস সারে না, এর অর্থ এই নয় যে, যারই এই অসুখ হবে, তার ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। ‘শৃঙ্খলাই জীবন’ এই বিশেষ বাক্যটির উল্লেখ করে বলতে চাই, পরিমিত খাদ্য, নিয়মিত ওষুধ ও সুশৃঙ্খল জীবন—এ তিনটি নীতিকে যেসব ডায়াবেটিসের রোগী সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন, তাঁরা অবশ্যই সামাজিকভাবে উপযোগী, স্বাভাবিকের কাছাকাছি সৃজনশীল কাজে সক্ষম ও সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারবেন। সেই সঙ্গে আরও বলতে চাই, যাঁরা এখন থেকে একটি হেলদি লাইফ স্টাইল অথবা যাঁরা একটি স্বাস্থ্যসম্পন্ন জীবন ব্যবস্থা মেনে চলতে পারবেন, তাঁরাও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারবেন—আজকের দিনে এই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.