চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের রেকর্ডঃ রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যা দেড়শ’ অতিক্রম করেছে। এই রেকর্ড সংখ্যক নিয়োগের ফলে নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না।

নিজেদের ন্যায্য পদোন্নতি নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়েছেন অনেক কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাপক হারে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ায় স্বভাবতই চাকরিক্ষেত্রে মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রশাসনে গতিশীলতা সৃষ্টি এবং সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই এ ধরনের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন ২০ জন। জানা গেছে, সচিব ও সচিব পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন আট কর্মকর্তা। অথচ বর্তমানে ১৪ সচিবকে ওএসডি করে অলস বসিয়ে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় অহেতুক রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ অপচয় হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বাকিরা নিয়োগ পেয়েছেন রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে। বেসামরিক প্রশাসনে বেশি সংখ্যক সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। সংখ্যার বিবেচনায় এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ভঙ্গ করেছে অতীতের সব রেকর্ড। এ ব্যাপারে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগের সরকারগুলোর সময়ও বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এত বেশি নিয়োগ এবারই প্রথম। এটা খুব সহজ হিসাব যে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যা যত বাড়বে, তত বেশি সংখ্যক নিয়মিত কর্মকর্তা বঞ্চিত হবেন। তাই হয়েছে। ফলে বর্তমান জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা দিয়েছে চরম অসন্তোষ। বলা হচ্ছে, নিয়মিত সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি সরকারের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়ায় সেই সঙ্কট পূরণ করা হচ্ছে ব্যাপকহারে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে। যাকে এক কথায় বলা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ। এ অবস্থায় মেধা, জ্যেষ্ঠতা এবং অভিজ্ঞতার মতো জরুরি বিষয়গুলো বিবেচিত হচ্ছে না। অর্থাত্ রাজনৈতিক আনুগত্য এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে গ্রাহ্য হচ্ছে। কিন্তু মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতা প্রাধান্য না পেলে শুধু প্রশাসনে সুশৃঙ্খল পরিবেশেরই সঙ্কট দেখা দেয় না, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার আশঙ্কাও বাড়ে। এও ধ্রুব সত্য যে, আমলাদের রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা না গেলে প্রশাসনে গতিশীলতা আনা দুরূহ। এ ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা এবং নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রকাশ্য-গোপন মতানৈক্য বৃদ্ধিরও সুযোগ তৈরি হয়। প্রভাবশালী আমলা এবং মন্ত্রীদের মধ্যেও মতভেদ দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়। মাঝেমধ্যে মন্ত্রী-আমলা বিরোধের যে খবর ছাপা হয় তা যে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ থেকে সৃষ্ট—এমন ভাবা অমূলক নয়। এ ধরনের বিরোধ বাড়তে থাকলে প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড শিথিল হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতেই পারে। দেখা যায়, সরকার পরিবর্তনের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদেরও চাকরি চলে যায়। এর কারণ সবারই জানা। কাজেই প্রশাসনে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তথা দলীয় বিবেচনার চর্চা এবং তার পরিবেশ সৃষ্টি করা অনভিপ্রেত।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোনো ধরনের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, বদলি চলতে পারে না, উচিত নয়। এতে জনপ্রশাসনের সর্বস্তরে হতাশা ও নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থাকে। রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেলে প্রশাসনের মান কমবে, দুর্নীতি বাড়বে। অর্থাত্ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পক্ষপাতদুষ্ট হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে শুধু অঙ্গীকারের মধ্যেই। কেননা, প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় সরকারি কর্মকাণ্ড, বাস্তবায়িত হয় নীতিমালা ও অন্যান্য নির্দেশনা। তাই প্রশাসনকে গতিশীল করার স্বার্থে সব ধরনের অনিয়ম এবং বাহুল্য নিয়োগ বন্ধ রাখা জরুরি। যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য এটি অনিবার্য শর্ত। সরকারকে এ শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.