জিয়াঃ পাথরে লেখা নাম মুছলেও হৃদয়ে থেকে যাবে by ড. মাহবুব উল্লাহ্

মনে হচ্ছে সব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকে শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। কারণ, ওই নামের মানুষটিকে কেন্দ্র করে এদেশে একটি নতুন ধারার রাজনীতির সূত্রপাত ঘটেছে। যে রাজনীতি আওয়ামী লীগের প্রথম ২৯ বছর ধরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ভিত্তির উপর মরণ আঘাত হেনেছে।

১৯৭৮-এ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্ম। আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। সেই হিসেবে ২৯ বছরের জ্যেষ্ঠ একটি রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তার নবযাত্রা সূচনা করে। এর পরবর্তী বছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। জন্মলাভের এক বছরের মধ্যেই এই দলটির সাফল্য রীতিমত ঈর্ষণীয়। প্রথমবারের মতো এই দলকে ক্ষমতা থেকে হটাতে সামরিক আইন জারি করা প্রয়োজন হয়েছিল এবং এরই মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল একজন সামরিক শাসক যার নাম জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এর আগে বিএনপির রাজনীতিকে অর্থাত্ জাতীয়তাবাদী ভাবধারার রাজনীতিকে উত্খাতের জন্য দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের হোতারা এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হত্যা করেছিল জিয়াকে। কিন্তু জনমনে জিয়ার উপস্থিতি এতই প্রবল ছিল যে, এরশাদকে তার শাসনামলের প্রথম দিকে জিয়ার ছবি পাশে রেখেই তার শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়েছে। এর আরেকটি সম্ভব্য কারণ হচ্ছে জিয়াউর রহমান সৈনিকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। জিয়া বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন এমন কোনো ঝুঁকিও এরশাদের মতো সামরিক শাসকও নিতে চাননি।
আওয়ামী লীগের যে ২৯ বছরের ইতিহাসের কথা বলেছি তার থেকে প্রায় ৭ মাস ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে। বাকশাল গঠনের ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমন অস্তিত্ব হারিয়েছিল তেমনি অস্তিত্ব হারিয়েছিল বহু বছরের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগও। সেই হারিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান তার বহুদলীয় রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে। সে কারণে আওয়ামী লীগের জিয়াউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। তা কিন্তু হয়নি, কারণ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হতে পেরেছিল অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে। পরবর্তীকালে শহীদ জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার স্বামীর রেখে যাওয়া দলটির সার্থক নেতৃত্ব দিয়ে তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ অলঙ্কৃত করেছেন। শত প্রতিকূলতা ও নানা ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন, উন্নয়নের এই ধারা সূচিত হওয়ার ফলেই বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘোঁচাতে পেরেছে, দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বল্গাহীন হারকে দমিত করতে পেরেছে, মানুষের গড় আয়ু ৬৪ বছরে উন্নীত করতে পেরেছে, দারিদ্র্যের হার হ্রাস করতে পেরেছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সন্তোষজনক জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করতে পেরেছে, নারীর ক্ষমতায়নে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, বিদেশে বাংলাদেশীদের জন্য ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত শূন্য রাজকোষকে সমৃদ্ধ করে দাতাগোষ্ঠীর কাছে দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এবং রফতানিমুখী শিল্প উন্নয়নের ধারা প্রবর্তন করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সড়ক যোগাযোগের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। খাদ্য উত্পাদনেও প্রায় স্বয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে। শহীদ জিয়ার নাতিদীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল, সেই সময় জাপানের মতো বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রাষ্ট্রকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজিত করে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। ইরাক-ইরান যুদ্ধে বাংলাদেশের সক্রিয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা এবং আলকুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অবস্থান বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। গনচীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করে এবং বাংলাদেশ ও গনচীনের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করে বাংলাদেশের দেশরক্ষণ ব্যবস্থাও সুদৃঢ় হয়েছিল। জাতি গঠনে শহীদ জিয়া যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তার জন্য অনন্তকাল ধরে কৃতজ্ঞচিত্তে বাংলাদেশীরা শহীদ জিয়াকে স্মরণ করবে প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ মহাজোট সরকার জিয়ার নাম মুছে ফেলা সত্ত্বেও।
জিয়ার নাম মুছে ফেলার জন্য কখনও জিয়ার প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত ম্যুরাল গাঁইতি শাবল দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় কখনও অতি কদর্য ভাষায় জিয়ার সমালোচনা করা হয়। আবার কখনও আইনের আশ্রয় নেয়া হয়। আদালতের রায়ের পর এখন আর আমরা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে পারব না।
পাকিস্তান আমলে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভার অসংখ্য রিপোর্ট সংবাদপত্রে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সশরীরে তার জনসভায় উপস্থিত থেকে তার অনলবর্শী বাগ্মীতা উপভোগের সুযোগও হয়েছিল। তার একটি প্রিয় উক্তি ছিল, যে আইন মানুষের কল্যাণ করে না, সেই আইন আমরা মানতে বাধ্য নই। একই ধরনের উক্তি করতেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি। তিনি আইন অমান্য আন্দোলনের কথাও বলতেন। খাজনা ট্যাক্স প্রদান বন্ধ করারও হুমকি দিতেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীও লবণ আইন অমান্য করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং গান্ধীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অহিংস সত্যাগ্রহ করেছিলেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন। ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ সত্যির উদ্বোধন’। যাই হোক ওগুলো সব ইতিহাসের কথা। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো ইতিহাসের দোহাই সবাই পাড়ে। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এবার জিয়ার উপর খড়্গহস্ত হয়েছেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বুধবার ভারতের ত্রিপুরায় ‘বাণিজ্যমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা ফেরার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউসে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, আশুগঞ্জ জিয়া সার কারখানার নাম আইনসিদ্ধ নয়। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদফতরে প্রতিষ্ঠানটির নাম এখনও আশুগঞ্জ সারখানা আছে। তাই বিসিআইসি কারখানার আইনসিদ্ধ নাম ‘আশুগঞ্জ সার কারখানা’ ব্যবহার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আইনগত খুঁটিনাটির দোহাই তুলে এখন এত দিনের পরিচিত জিয়া সার কারখানা আর জিয়া সার কারখানা থাকছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃপায় টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে কৃতজ্ঞতার দায় পরিশোধের এক সাধু প্রচেষ্টা বটে! যতদূর জানি দিলীপ বড়ুয়া সাম্যবাদী দলের নেতা। এই দলটি এখন একটি নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ উত্তরকালে কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার ও কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে দলটি একটি গোপন বিপ্লবী দল হিসেবে সচেতন মানুষের কাছে যথেষ্ট মর্যাদা অর্জন করেছিল। জিয়াউর রহমানের গণতান্ত্রিক রাজনীতি দলটিকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। জিয়াউর রহমান মোহাম্মদ তোয়াহাকে সম্মানও করতেন। মোহাম্মদ তোয়াহা ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। রক্ষীবাহিনীর হাতে দিলীপ বড়ুয়ার দলটির কতজন সদস্য প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই তথ্য দিলীপ বড়ুয়ার অজানা থাকার কথা নয়। শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক সহবস্থানের নীতি সাম্যবাদী দলকেও সম্মানের আসনে নিয়ে আসে। দিলীপ বড়ুয়ারা সেই সম্মানের আসন ধরে রাখতে পারেনি। এখন দিলীপ বড়ুয়া উপকারকারীর অপকার করে কৃতঘ্নতে পরিণত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে এক ব্যক্তি বলেছিল, অমুক আপনার নিন্দা করেছে। জবাবে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, আমি তো তার কোনো উপকার করিনি। এখন মনে হচ্ছে শহীদ জিয়া দলমতনির্বিশেষে সবাইকে নিজ নিজ রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে অনেকেরই নিন্দা ভাষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোনো অস্বীকৃতি, কোনো নিন্দাভাষণ এবং কোনো অসভ্য প্রয়াস জিয়ার নামকে জনগণের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.