লাশের অমর্যাদাঃ একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি by মাহমুদ শামসুল হক

মৃতদেহ নিয়ে মানুষের কর্মকাণ্ড কোনো মূল্যহীন আবেগ নয়। যদিও কোনো কোনো দার্শনিক মনে করেন, প্রাণহীন দেহ অন্যান্য পরিত্যক্ত বস্তুর শামিল। সেটি চোখের আড়াল করার পর জীবিতদের দায়িত্ব শেষ। এরপর লাশের উদ্দেশ্যে যা কিছু করা হয় তা নিছকই বালখিল্যতা।

কিন্তু মানুষ মানুষবত্ হয়ে ওঠার পরের ইতিহাসের বিপরীত অবস্থার কথাই বলে। মানুষের আবেগ-অনুরাগ, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা, প্রেরণা-প্রণোদনা-প্ররোচনা ইত্যাদির সঙ্গে মৃতের-স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। এই স্মৃতি কখনও দু-দশ দিনেই আবছা হয়ে যায়, কখনও যুগ-যুগান্তর ধরে অসংখ্য মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এসব বিবেচনা থেকেই লাশের সত্কার করার নানারকম আয়োজন করেছে মানুষ। জীবিত ব্যক্তিকে স্মরণে রাখার তাগিদে তৈরি করেছে সমাধিসৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ। মমি, ভাস্কর্য, মূর্তি, ছবি ইত্যাদির মাধ্যমে মৃতের কীর্তির পাশাপাশি তার কায়াকেও ধরে রাখার জন্য বের করেছে অজস্র উপায়। এসব স্মারকে মানুষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তাকে সাক্ষী রেখে শপথ নেয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে। কাজেই লাশ এবং লাশের অবস্থান মানুষের মনে বিস্তর প্রভাব সৃষ্টি করে—সমকালে তো বটেই, বহুকাল পরেও। এই সত্যকে সামনে রেখেই প্রাচীনকাল থেকে লাশের সদগতি, দুর্গতি, সমাধি সংরক্ষণ এবং উত্খাত অযাচিত রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
লাশ এবং সমাধি নিয়ে নৃশংসতম রাজনীতির চর্চা হয়নি এমন কোনো রাজ্য বা দেশের অস্তিত্ব ছিল না, নেই। ইতিহাস তার সব ঘটনাই সংরক্ষণ করেনি। যাদের কীর্তি ও অবদান ইতিহাসের নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছে, জাতিকে উজ্জীবিত করেছে, মানবসভ্যতাকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান, ইতিহাস সরব হয়েছে তাদের নিয়েই। অনেক ক্ষেত্রেই জীবিত ব্যক্তির চেয়ে বহু বেশি শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মৃত মানুষের মহিমা। এই আশঙ্কাকে সামনে রেখেই ভিন্ন মতাদর্শীরা লাশের অমর্যাদা করে কিংবা সমাধিক্ষেত্র নিশ্চিহ্ন করে তার অনুসারী-অনুগামীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়, স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে নষ্ট করে স্মৃতিচিহ্ন, ভাস্কর্য, স্মারক ইত্যাদি। সম্ভবত লাশের ওপর ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার প্রথম বড় ধরনের ঘটনাটি ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিসে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর রচিত গ্রন্থের ভাষ্যকার ছিলেন বিদুষী হাইপাসিয়া। এই অপরাধে তাকে রাস্তায় নগ্ন করে আবদ্ধ করা হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার চার্চে। ধর্মযাজক সেন্ট সিরিলের আদেশে সেখানে হাইপাসিয়াকে হত্যা করার পর তার মস্তক ছেদন করা হয়। তারপর টুকরো টুকরো করে হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে নিক্ষেপ করা হয় অগ্নিকুণ্ডে। এই রোমহর্ষক অপরাধের জন্য ধর্মোন্মাদ সিরিলকে কোনো প্রকার জবাবদিহি করতে হয়নি। কিন্তু তার ওপর ইতিহাস ক্রমাগত অভিশাপ বর্ষণ করেছে, অন্যদিকে হাইপাসিয়া পেয়েছেন অমরত্ব। শব-লাঞ্ছনার আরেক মর্মদাহী ইতিহাস রচিত হয়েছিল ইরাকের কারবালায়, ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে। এখানে এজিদ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হোসেন (রা.)। অবরুদ্ধ ফোরাত নদীর তীরে পিপাসা-কাতর হোসেন নিহত হন সীমারের অস্ত্রাঘাতে। এরপর তাঁর ছিন্নমস্তক বর্শায় বিদ্ধ করে প্রকাশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় দামেশকে এজিদের কাছে। এদিকে কারবালার বালুকায় পড়ে থাকা হোসেনের মস্তকবিহীন লাশ পদদলিত করে জনৈক আদি ইবনে হাতিম। ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণে এই নৃশংস ঘটনার কারণ যতটা না ব্যক্তিগত শত্রুতা, তার চেয়ে বহু বেশি রাজনৈতিক। এরপর স্বভাবতই এই রাজনৈতিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হয়েছে। হোসেনের রক্তের দাগ না শুকাতেই হোসেন-হত্যার নেপথ্য নায়ক ইবনে জিয়াদকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার লাশ। এ ঘটনার নায়ক ছিলেন ইব্রাহিম (৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ)। স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটাতে খলিফা আবু বকর (রা.)-এর মেয়ে আসমার ছেলে আবদুল্লাহকে হত্যা করে কয়েকদিন তার লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ফাঁসিকাষ্ঠে। অবশেষে সেই গলিত-বিকৃত লাশ হস্তান্তর করা হয় মা আসমার কাছে। ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে এই নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে ছিলেন উমাইয়া সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহ্নি নির্বাপিত করার উদ্দেশ্যে আব্বাসীয় সেনাপতি আবদুল্লাহ উত্খাত করেছিলেন উমাইয়া খলিফাদের কবরস্থান, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে। দামেশকের সমাধি থেকে তুলে ফেলা হয়েছিল খলিফা সুলাইমানের শব। রোসাফায় খলিফা হিশামের কবরস্থ কঙ্কালে আশি বার বেত্রাঘাত করে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। আব্বাসীয় খলিফা মনসুরের আমলে (৭৬৩ খ্রি.) কুফার যুদ্ধে প্রতিপক্ষের সেনানায়ক ইব্রাহিম নিহত হলে তার মাথা কেটে পাঠিয়ে দেয়া হয় খলিফাকে দেখানোর জন্য। বাগদাদে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে কবর থেকে সুফী-সাধকদের দেহাবশেষ তুলে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন হালাকু খান ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস তার পিতার হত্যাকারীদের মেরে বিদ্রোহের নায়ক ক্রমওয়েল, ইরিটন, ব্রাডস প্রমুখের লাশ সমাধি থেকে বের করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেন প্রকাশ্যে। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুদানে এক অভিযান চালিয়ে মারা যান ইংরেজ সেনাপতি গর্ডন। এ হত্যার প্রতিশোধ নিতে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে সেখানে যান সেনাপতি কিচনার। জর্দানের রাজধানী খার্তুম দখল করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেন সুদানের মেহেদিপুত্র আবদুল্লার লাশ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটাতে বঙ্গদেশেও এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, নবাব সিরাজদ্দৌলাহকে হত্যার পর তার লাশ টেনে-হিঁচড়ে দেখানো হয়েছিল মুর্শিদাবাদের রাস্তায়, তারপর খণ্ড খণ্ড করে তুলে দেয়া হয়েছিল পরিজনের কাছে। লাশের অমর্যাদা করার এই পৈশাচিক রাজনীতির খেলায় জিতেছিল ইংরেজরা। বাঙালির হৃদয়ে ভীতি-সঞ্চারের মধ্য দিয়ে আসন্ন বিদ্রোহের আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়েছিল তারা।
স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিক শীর্ষ নেতার লাশ ও সমাধিসৌধ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে একাধিকবার বিরূপ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাসের নিয়মেই তাতে মৃত ব্যক্তিত্বের মহিমার কোনো উনিশ-বিশ হয়নি, হবে না। শুধু পক্ষ-প্রতিপক্ষের স্বজন, অনুরাগী-অনুসারীদের মধ্যে আক্রোশ সঞ্চিত হবে এবং তা সুযোগ পেলেই পরিণত হবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে; যে রাজনীতি বিবেকবান মানুষ চিরকাল প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.