আরব বিশ্ব-গণজাগরণের নিয়তি by রবার্ট ফিস্ক

উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে গত পাঁচ সপ্তাহের রাজনৈতিক ভূমিকম্প ছিল সবচেয়ে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, বিধ্বংসী, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। প্রাচ্যবাদে সহজে বশ মানা, নিষ্কর্মা, পুনর্বিকাশ-ক্ষমতাহীন, দাসসুলভ আরব চরিত্রের যে উপস্থাপনা, তা উল্টে দিয়ে তারা হয়ে উঠেছে মুক্তি, স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য লড়াকু।


পশ্চিমারা এই ভূমিকা একমাত্র তাদের আওতাধীন দাবি করেছে সব সময়। একের পর এক শাসকের পতন ঘটছে। যে জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পশ্চিমারা সেসব শাসককে পুরস্কৃত করে গেছে, সেই জনতা রচনা করছে তাদের নিজস্ব ইতিহাস। আরববাসীর জীবনে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের অধিকার (পশ্চিমারা সেই অনধিকার চর্চা অব্যাহতই রাখবে যদিও) পশ্চিমারা চিরতরে খোয়াচ্ছে।
কয়েক যুগের অচলায়তন ভেঙে যাচ্ছে। ট্র্যাজিক অথচ সাহসী ফল পাওয়া যাচ্ছে। বহু আরব নৃপতি দাবি করেন, তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র চান। সিরিয়ার বাদশাহ বশির সরকারি কর্মিবাহিনীর বেতন বাড়াতে যাচ্ছেন। আলজেরিয়ার বাদশাহ বোতেফ্লিকা হঠাৎ করেই বহু দিন ধরে চলতে থাকা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করেছেন। বাহরাইনের বাদশাহ হামাদ কারাগারের দরজা খুলে দিয়েছেন। সুদানের বাদশাহ বশির আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হবেন না। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ধারণা পাঠে নিমগ্ন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ। আর আল-কায়েদা তো এখন বড় নীরব।
কে ভাবতে পেরেছিল গুহাবাসী বুড়োটাকে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। মুক্তির আলোয় ঝলসে যাবে তাঁর চোখ। মুসলিম বিশ্বে শহীদের অভাব হয়নি কোনো দিন। কিন্তু কোথাও দেখা যায় না কোনো ইসলামি ঝান্ডা। স্বৈরতন্ত্রের নিদারুণ যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছেন যে তরুণ নারী ও পুরুষ, তাঁরা মূলত মুসলমান—মৃত্যুবাসনার চেয়ে তাঁদের মানবিক চেতনা ছিল বড়। তাঁরা ধর্মবিশ্বাসী সত্য, কিন্তু মোবারককে হঠানোর জায়গায় তাঁরাই তো পৌঁছালেন আগে। বিন লাদেনের হুকুমবরদারেরা তখনো তাঁদের সেকেলে ভিডিও টেপে মোবারকের উচ্ছেদের আহ্বানই জানিয়ে যাচ্ছেন।
এবার এক সতর্কবাণী। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। বজ্র-বিদ্যুৎ ঝঞ্ঝার আগে যেমন উষ্ণ ও হালকা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি টের পাওয়া যায়, তেমনি এক অনুভূতি আজ পাচ্ছি। গাদ্দাফির চূড়ান্ত লোমহর্ষক চলচ্চিত্র শেষ হয়নি, যদিও প্রহসন ও রক্তপাতের মিশ্রণে তৈরি এমন ছবি মধ্যপ্রাচ্যে আমরা অনেকবার দেখেছি। তাঁর অবধারিত পরিণতি আলো ফেলছে পশ্চিমা বাদশাহদের তোষামোদকারী চরিত্রের ওপর; স্বার্থ হাসিলের জন্য জালিমের সঙ্গে মিত্রতার ওপরও। বেরলুসকোনি, সারকোজি ও ইসফাহানের লর্ড ব্লেয়ারকে আমরা যতটা মলিন ভাবতাম, তার চেয়েও মলিন আজ তারা। খুনি গাদ্দাফিকে মহিমান্বিত করে গেছে এরা।
এখন মিসরকে সবাই ‘তুর্কি মডেল’ অনুসরণ করতে বলছে। এ তো গণতন্ত্র ও সুনিয়ন্ত্রিত ধর্মের মজাদার মিশেল। তা-ই যদি হয়, তাহলে মিসরের সেনাবাহিনী আগামী কয়েক দশক জনগণের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত, অগণতান্ত্রিক নজরদারি করবে। যেমন বলেছেন আইনজীবী এজ্জাতিয়ার, ‘মিসরীয় জীবনপ্রণালি হুমকির মুখে পড়ার কথা বলেছে সেনাবাহিনী...এ ক্ষেত্রে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি ইঙ্গিত ততটা সূক্ষ্ম নয়। এ যেন তুর্কি ইতিহাসের পাতা থেকেই নেওয়া।’ আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে সেনাবাহিনী রাজনীতির প্রধান কুশীলব হয়েছে চারবার। আর মিসরীয় সেনাবাহিনীই তো নাসেরকে সৃষ্টি করেছিল, সাদাতকে তৈরি করেছিল আর যখন খেল খতম, তখন সাবেক জেনারেল মোবারককে বিদায় করে দিল। সবখানেই সেনাবাহিনী।
আর খাঁটি, মুক্ত ও নিখুঁত না হলেও উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের যে সংস্করণ পশ্চিমারা এত দিন ভালোবেসে (আর সঠিকভাবেই) নিজেদের জন্য গড়ে তুলেছে, সেই গণতন্ত্র আরব বিশ্বে এলে তা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক আচরণ ও পশ্চিম তীরে তাদের ভূমিদস্যুতার সঙ্গে সখ্য গড়বে না। মোবারকের স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখা আবশ্যক—সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে ইসরায়েলের এমন যুক্তি বর্তমানে আর চলবে না। মুসলিম ব্রাদারহুডের নাম করে বরাবরের মতো ইসরায়েলি লবি ভীতি তৈরির ব্যবসায় নেমে আবারও ওবামা ও ক্লিনটনকে বিপথগামী করল। নিপীড়নের রাজ্যে যখন গণতন্ত্রকামীরা বিক্ষোভ চালাচ্ছে, তখন তারা নিয়মমাফিক নিপীড়ককেই সমর্থন দিয়ে যেতে লাগল, ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে। ‘সুশৃঙ্খলভাবে উত্তরণ’-এর বুলি শোনা গেল। ‘সুশৃঙ্খল’ শব্দই সব কথা বলে দেয়।
তবে বাহরাইনে এক বাজে অভিজ্ঞতা হলো আমার। বাদশাহ হামাদ ও ক্রাউন প্রিন্স সালমান দেশটির ৭০ শতাংশ (নাকি ৮০ শতাংশ?) শিয়া জনগোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করে কারাগারের দরজা খুলে দেওয়া ও সাংবিধানিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেন। মানামায় এক সরকারি কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আসলেই সংস্কার সম্ভব কি না। খলিফা রাজপরিবারের সদস্যের বদলে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কেন নয়? তিনি বললেন, ‘অসম্ভব। উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) কখনো তা অনুমোদন করবে না।’ জিসিসির জন্য নজর দিন সৌদি আরবের ওপর। তাহলেই হয়েছে। নিরাশার মেঘ উঠল।
এসব স্বৈরাচারী, লুণ্ঠনজীবী রাজপুত্রের ওপর আমরা তেমন নজর দিই না। আমরা ভাবি এরা সম্পদশালী, সেকেলে আর আধুনিক রাজনীতি বোঝে না। ওয়াশিংটনের অর্থনীতি উদ্ধারে পর্যাপ্ত অর্থ জোগান না দিতে পারলে যখন বাদশাহ আবদুল্লাহ সেই ঘাটতি পূরণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন, আমরা তখন হাসি, আর এখন আমরা হাসছি যখন নাগরিকদের জন্য বৃদ্ধ বাদশাহ ৩৬ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করতে চাইছেন। কিন্তু এসব মোটেই হাস্যকর ব্যাপার নয়। যে আরব বিদ্রোহ অবশেষে আরব ভূমি থেকে উসমানীয়দের হটিয়ে দেয়, তার শুরু সৌদি আরবের মরুভূমিতে। সেখানকার উপজাতীয় অধিবাসীরা তখন লরেন্স, ম্যাকমোহন ও পশ্চিমা বাহিনীর ওপর আস্থা রেখেছিল। সৌদি আরব থেকেই ওয়াহাবি মতবাদ ছড়িয়েছে। এই মতবাদের ভয়ানক সরলতা সুন্নি দুনিয়ার সব ভাবী ইসলামপন্থী ও আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর কাছে আবেদন সৃষ্টি করে। ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদা এবং তালেবানকে লালন-পালন করেছে সৌদি আরব। ১১ সেপ্টেম্বরের হামলায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই সৌদি নাগরিক। আমার মনে খচখচ করছে এক সন্দেহ: আমাদের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এখন যে গণজাগরণ ঘটে চলেছে, তার নিয়তি নির্ধারিত হবে সেই রাজত্ব, যেখানে আছে তেল, পবিত্র ভূমি আর দুর্নীতি। নজর রাখুন।
দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.