মন্ত্রীর নির্দেশ শিরোধার্যঃ উদ্দেশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হামলাকারীদের নির্মূল ও শিবিরের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রকাশ্যেই দিয়েছেন। কিন্তু সরকার এখনও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি, এ কথা ভুলে গিয়ে মন্ত্রীর নির্দেশ শিরোধার্য করে নির্মূল অভিযানে নেমেছে র্যাব ও পুলিশ বাহিনী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৈতন্যপুর গ্রামে বাড়ি ঘেরাও করে ছাত্রশিবির নেতা শাহীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ধরনের নির্মূল অভিযান চলছে দেশজুড়ে। রাজশাহী শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ক্যাডারদের উন্মত্ত হামলার শিকার হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের কার্যালয়, কোচিং সেন্টার, ছাত্রদের মেস, হোস্টেল, এমনকি বাড়িঘরও। নিরাপত্তাহীনতায় প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শত শত ছাত্র। এভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলের ঘটনা সাম্প্রতিককালে নজিরবিহীন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটে। সেখানে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হন। তিনি কোনো দল করতেন না। গরিব কৃষকের সন্তান আবু বকর হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে এসে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। আবু বকর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এটা কোনো ব্যাপার নয়, এমনটা হয়েই থাকে’। এর ফলেই সম্ভবত প্রায় দু’সপ্তাহ হতে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। অথচ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর পরই তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। র্যাব-পুলিশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জেলায় জেলায়। সরকারি দলের ক্যাডাররাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে সর্বত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মীদের হামলার ছবি তুলতে গিয়ে সাংবাদিকরাও মারপিটের শিকার হয়েছেন। সহকারী প্রক্টর ও অন্য এক শিক্ষকও রেহাই পাননি ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাত থেকে।
আওয়ামী মহাজোট সরকারের শুরু থেকেই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের সিট দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে তাণ্ডব শুরু করে। এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে রক্ত ঝরেছে একাধিক ক্যাম্পাসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমিটি বাতিল, তত্পরতা নিষিদ্ধ ও দু’চারজনকে বহিষ্কার করে সামাল দেয়া যায়নি ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেও কোনো কাজ হয়নি। বেপরোয়া পাগলা ঘোড়ার মতোই দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তারা। কারও বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি পুলিশ প্রশাসনকে। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনার মুখেও নিশ্চুপ থাকতে হয়েছে তাদের। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মী নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শিবির-উত্খাতের নির্দেশ দেয়ার পরদিনই পুলিশের গুলিতে নিহত হন রাজশাহী কলেজের ছাত্রশিবিরের নেতা শাহীন। অবশ্য পুলিশ একথা অস্বীকার করে বলছে, শিবিরকর্মীরাই তাকে গুলি করে পালিয়ে গেছে। খুবই অদ্ভুত কথা! গভীর রাতে অর্ধশতাধিক পুলিশ নিয়ে বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি চলাকালে নিজেদের লোককে গুলি করে অস্ত্রসহ পালিয়ে যাওয়ার কথা রহস্যোপন্যাসের ঘটনাকেও হার মানায়। এটা যে খুবই খোঁড়া যুক্তি এবং মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে চাকরি রক্ষা করতে পুলিশকে এভাবে খড়কুঠো আঁকড়ে ধরতেই হবে।
এমন পরিস্থিতি মোটেই নতুন নয়। অতীতেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। স্বাধীনতার পর তত্কালীন সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চরমে উঠেছিল। তখনও উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ, বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী সরকারবিরোধী হাজার হাজার নেতাকর্মীকে খুন ও গুম করেছিল। সে স্মৃতি বয়স্কদের এখনও ভীত করে তোলে। তার পরিণতি অবশ্য সবার জানা। একদলীয় বাকশালী শাসনরক্ষায় বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, আজকে কেউই সে অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবেন না। এখন সবাই সংবিধান, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার কথা বলেন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রধান শর্ত হচ্ছে আইনের শাসন কায়েম করা। অভিযুক্ত যেই হোক তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেখানে আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আইনের শাসন বাধাগ্রস্ত হতে পারে এমন অগণতান্ত্রিক নির্দেশ দেয়া কিছুতেই সমীচীন নয়; অন্তত গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা করার স্বার্থে। বিষয়টা সবার মনে রাখা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.