চরাচর-নয়ীম গহর : হারিয়ে যাচ্ছেন বিস্মৃতির অন্তরালে by শাহ মতিন টিপু

দেখতে সুদর্শন, চেহারায় বয়সের ছাপ। যেন রণক্লান্ত। নিজের বাড়িতে নিশ্চুপ সময় কাটছে তাঁর। দুর্দান্ত উচ্ছল ছিল যাঁর তারুণ্যের জীয়নকাঠি। এখন বুকভরা অভিমান ও আক্ষেপই তাঁর পুঁজি। স্বাধীন দেশের উষালগ্নে যেটুকু অবদান আছে, তা নিয়েই আত্মতৃপ্তির সুখ খুঁজে বেড়ান এই নিভৃতচারী মানুষটি। নাম তাঁর নয়ীম গহর।


একাধারে গীতিকার, ঔপন্যাসিক, গায়ক, নায়ক, নাটক রচয়িতা, বিবিসির (লন্ডন) বাংলা ভাষ্যকার ও খবর পাঠক। অনেক প্রতিভার অধিকারী, কিন্তু প্রচারবিমুখ। বিক্রমপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম বাংলা ১৩৪৪ সনের ২৯ শ্রাবণ, ইংরেজি ১৪ আগস্ট, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। সবচেয়ে সর্বজনীন পরিচয়টি তাঁর, তিনি সৃষ্টি করেছেন বহু আধুনিক ও মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়স্পর্শী গান। ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোতে যাঁর গান মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছে। যেমন_'নোঙ্গর তোলো তোলো সময় যে হলো হলো', 'সাগর পাড়িতে ঝড় জাগে যদি জাগতে দাও', 'পুবের ওই আকাশে সূর্য উঠছে আলোকে আলোকময়', 'জয় জয় জয় জয় বাংলা' (এ গানটি এইচএমভি/ইএমআই রেকর্ড করেছিল)। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে রেকর্ড করা হয় গান দুটি। গান দুটির সুরকার ছিলেন সমর দাস। জনপ্রিয় আরেকটি গান 'জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো'_সুরকার আজাদ রহমান। দেশাত্মবোধক গানের পাশাপাশি অনেক জনপ্রিয় আধুনিক, উচ্চাঙ্গসংগীত রচনা করেন তিনি। যার সংখ্যা প্রায় ২০০। 'সোনার কাঠি রুপার কাঠি তোমার হাতে দিলাম, বিনিময়ে স্বপ্ন দেখার তন্দ্রাটুকু নিলাম'_সুর করেছেন আজাদ রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর রচনায় প্রথম নাটক বিটিভিতে প্রচারিত হয় 'পাখি আমার জয়ন্ত' (জয়ন্ত তাঁর ছেলের নাম)। পরিচালক ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। প্রধান পাত্র-পাত্রী ছিলেন সুজাতা ও গোলাম মোস্তফা। ফজলে লোহানী ও নয়ীম গহর মিলে একটি নতুন ধারার টিভি অনুষ্ঠান করেন_'যদি কিছু মনে না করেন' শিরোনামে। 'ইচ্ছে করেই যাঁরা ভুল করেন, জেনেও না জানার ভান করেন, তাঁদের কিছু ভুল বুঝিয়ে দেব'_এ গানটিও তাঁরই রচনা। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাঁর ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নয়ীম গহরকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। তখনকার চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন 'রূপছায়া' নয়ীম গহরের ছবিসহ লিখেছিল, 'সম্ভাবনাময় একটি মুখ, আগামীতে এর পরিচয় পাবেন। কেউই ভাবছেন না তাঁকে নিয়ে। কিছুই করছেন না নয়ীম গহরের জন্য।' ছাত্রজীবনেও তিনি অত্যন্ত মেধার পরিচয় দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি একজন ভালো চিত্রকরও। তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে ইলোরা গহর চলচ্চিত্রে এবং ছোট পর্দায়ও সুনাম কুড়িয়েছেন। 'যদি কিছু মনে না করেন'-এর প্রথম অনুষ্ঠানে দুই বোন_অজন্তা, ইলোরা তাঁদের বাবার লেখা গান গেয়ে বেশ সুনাম করেছিলেন। নয়ীম গহর স্বাধীনতার জন্য শুধু গানই রচনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেননি, তিনি জীবন বাজি রেখে বঙ্গবন্ধুর জরুরি বার্তা অতিগোপনে ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকীর কাছে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো নয়ীম গহর জীবন বাজি রেখে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পেঁৗছে দিয়েছিলেন। এই দেশ ও জাতির জন্য অনেক অবদান রেখেও পরিণত বয়সে নিজ বাড়িতে নয়ীম গহর আজ নিভৃতচারী। বিধ্বস্ত-ম্লান অবয়বে ক্ষীণ হয়ে আসা চোখে আজ তাঁর অনেক প্রশ্ন ভাসছে। দীর্ঘশ্বাসে ঝরে পড়ছে অব্যক্ত বেদনা। এমন কিছু একটা কি করা যায় না, যাতে তিনি হাসিমুখ নিয়ে আবার গেয়ে উঠতে পারেন_'জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো...।'
শাহ মতিন টিপু

No comments

Powered by Blogger.