ইউরোপের জানালা-উইকিলিকস, তুষারপাত ও মন্দায় কাবু মহাদেশ by সরাফ আহমেদ

ইউরোপে শীতটা যেন এবার আগেভাগেই এসে গেল। সেই নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই জেঁকে বসেছে ঠান্ডা। শুধু কি ঠান্ডা, এর সঙ্গে হাড় কাঁপানো বাতাস আর তুষারপাত—কখনো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আবার কখনো আষাঢ়-শ্রাবণের ধারার মতো।


আর এই অবিরাম তুষারপাত ইউরোপের শহর-নগর-বন্দর বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাদা বরফের চাদরে ঢাকা পড়েছে।
তা ছাড়া ডিসেম্বর মাসে বড়দিন উৎসব আর নববর্ষকে বরণ করতে সর্বত্র সাজসাজ রব। ঘরবাড়ি, আঙিনা, দোকানপাট শহরের কেন্দ্রস্থল সুদৃশ্য ক্রিসমাস ট্রি আর নানা সাজসজ্জায় ঝলমল করছে। সাদা বরফে ঢাকা আবহে এই সাজসজ্জা যেন রূপকথার ছবিকেও হার মানায়। ইউরোপে এ সময়টা যথেষ্ট ঠান্ডা, বরফপাত হলেও বড়দিন আর নতুন বছরকে বরণ করার আনন্দে সবার মধ্যেই একটা খুশির আমেজ কাজ করে।
এই আনন্দ আর আমেজের মধ্যেই নানা প্রকৃতির বৈশ্বিক ঘটনা এবার এই বরণ উৎসবের কিছুটা হলেও ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। মহাদেশজুড়ে ডিসেম্বর মাসে প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে অস্থির হয়েছে অনেক দেশ এবং তাদের জনগণ।
প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই এবার ইউরোপজুড়ে তুষারপাত আর হিম ঠান্ডায় নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। প্রকৃতিবিদেরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বিশ্বজুড়ে যে এলোমেলো অস্বাভাবিক আবহাওয়া, তা থেকে নিস্তার পাচ্ছে না ইউরোপ। তাই বেশ আগেভাগেই তুষারপাত শুরু হওয়ায় এই নানা বিপত্তি। আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছেন, এই তুষারপাত আরও কিছুদিন চলবে এবং ঠান্ডার আধিক্যও বাড়বে।

এক.
এই শীতল আবহাওয়ায় হঠাৎ করে বোমা ফাটিয়ে সমাজ রাজনীতির অঙ্গন গরম করে দিয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তিনি তাঁর উইকিলিকস ওয়েবসাইটে আমেরিকার যুদ্ধনীতি এবং বিশ্বের নানা দেশ থেকে পাওয়া আমেরিকার কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশের মাধ্যমে অনেক দেশের রাজনীতিক আর নেতাদের সংশয়ের মধ্যে ফেলেছেন। নানা অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের। মুখ ফুটে কেউ না বললেও বা সমালোচনা না করলেও আকারে-ইঙ্গিতে তাঁরা তাঁদের বিরক্তি প্রকাশ করছেন আমেরিকার এই কূটচাল কূটনীতিকে।
বার্লিনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফিলিপ মরফি তাঁদের একজন, যিনি জার্মান রাজনীতির আঙ্গেলা মেরকেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভোলসহ অনেকের সম্পর্কে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কথাবার্তা লিখিতভাবে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন—তা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় রাজনীতিকদের মধ্যে একটা অস্থিরতা এবং দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যেও একটা শীতল ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে বার্লিনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ফেরত নেওয়ার কথা বলছেন। ইউরোপের চারটি বেনদি পত্রিকা স্পেনের এলপাই, জার্মানির ডের স্পিগেল, ফ্রান্সের ল্যা মন্ড ও ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান প্রতিদিন প্রকাশ করছে নানা কেচ্ছাকাহিনি। এই পত্রিকা চারটি ইউরোপে উইকিলিকসের তথ্যগুলো প্রকাশের জন্য চুক্তিবদ্ধ। এ ছাড়া ইউরোপের বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মধ্যবিত্তদের বিশাল অংশ উইকিলিকসের পক্ষে রয়েছেন, রয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলোও।

দুই.
ডিসেম্বরের ২ তারিখে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ফিফার সদর দপ্তরে ২০১৮ ও ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হিসেবে রাশিয়া আর কাতার নির্বাচিত হওয়াই ইউরোপে ফুটবল কুলীন দেশগুলোর চোখ কপালে উঠেছে। কদিন ধরেই ব্রিটিশ মিডিয়ার সঙ্গে অন্যরাও আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফাকে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা আর টাকা লেনদেনের আখড়া বলে সমালোচনা করেছেন। বিশ্বজনীন খেলা ফুটবল পৃথিবীর সর্বত্রই হতে পারে, যদি সে দেশের সামর্থ্য থাকে। তবে ফিফায় টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচার ঘটনা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট আর এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। ইংল্যান্ডের ফুটবলভক্তরা নিজ দেশে বিশ্বকাপ না পেয়ে শোকে পাথর হয়ে বছরের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন।

তিন.
চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক আবার রাষ্ট্রনায়ক, এ ধরনের রাজনীতিক ইউরোপে সাধারণত দেখা যায় না। তবে একজন আছেন, তিনি হলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি।
দুই বছর আগে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ইতালির ধনকুবের এবং মিডিয়াসম্রাট ৭৪ বছরের বেরলুসকোনি ইতালির জনগণকে নানা অর্থনৈতিক সংস্করণ এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও দিনে দিনে ইতালি বহুমুখী সংকটে ভুগছে। ইউরোপের যে দেশগুলো এই মুহূর্তে বিশাল ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে দেশ চালাচ্ছে, ইতালি তাদের মধ্যে অন্যতম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি না পেয়ে দিনে দিনে তার সূচক নামছে। এমন দিন নেই, যখন এই বছরের শেষ দিকে ইতালিতে এসবের প্রতিবাদে মিটিং-মিছিল হয়নি। ইতালির প্রখ্যাত সাংবাদিক বেপে সেভেরগিনি তাঁর সদ্য প্রকাশিত বইয়ে বেরলুসকোনিকে নিয়ে লিখেছেন, ব্যক্তি বেরলুসকোনি ইতালির টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এবং চলচ্চিত্রশিল্পের মালিক ও প্রযোজক হিসেবে যিনি নিজেকে বিপুল বৈভবের মালিক করেছেন আর তাঁর নারীবিষয়ক কেচ্ছাকাহিনি সর্বজনবিদিত, যদিও তা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণেই। কিন্তু দেশ চালাতে গিয়ে তিনি একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন। তারপর ১৪ ডিসেম্বর পার্লামেন্টের আস্থা-অনাস্থা ভোটে মাত্র তিন ভোটের ব্যবধানে তিনি ক্ষমতায় টিকে গেছেন। যদিও ইতালির বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যম এই অনাস্থা ভোটে ভোট ক্রয়ের অভিযোগ করছে।

সন্ত্রাসী হামলা
অক্টোবর মাস থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে খবর আসছিল, ইউরোপের বড় বড় শহর লন্ডন, প্যারিস, বার্লিনসহ আরও কিছু শহরে আল-কায়েদার ইউরোপীয় সহযোগীরা হামলা চালাবে। এতে হঠাৎ করেই চারদিকে পুলিশি প্রহরা বেড়ে গেল। পার্লামেন্ট ভবন থেকে শুরু করে বিমানবন্দর ও রেলওয়ে স্টেশনগুলোয় বাড়তি প্রহরা বসল। না, তেমন কিছু বড় হামলা আর হয়নি, তবে বার্লিনে জার্মান চ্যান্সেলর ভবনের ঠিকানায় পাঠানো প্যাকেটে বিস্ফোরক পাওয়া গেল। সুইডেনের স্টোকহোলাম ক্রিসমাস মেলায় বোমা ফুটলেও আততায়ী ছাড়া আর কেউ হতাহত হয়নি। ডিসেম্বরের শেষ দিকে হল্যান্ডের রটারডামে ১২ জন সোমালীয় নাগরিক গ্রেপ্তার হলো। হামলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রাক্কালে আর রোমের সুইজারল্যান্ড এবং চিলির দূতাবাস ভবনে প্যাকেট বোমা পাওয়া গেল। তবে এ ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদা নয়, উগ্র বাম যারা সুইজারল্যান্ডে তাদের কাজকর্মের জন্য নিষিদ্ধ, তাদের কাজ বলে প্রকাশ পেল।

অর্থনৈতিক সংকট
২০১০ সালের শুরু থেকেই ইউরোপীয় নেতারা ইউরো মুদ্রামানের সংকট ঠেকাতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।
বিগত মাসগুলোয় গ্রিস ও আয়ারল্যান্ডের আর্থিক সংকট ইউরোর মুদ্রামান বেশ সংকটের মুখে পড়ে। এ ছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে ইতালি, পর্তুগাল ও স্পেনের মতো দেশগুলোও।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের মধ্যে ১৬টি দেশে প্রচলিত ইউরোর মুদ্রামানের ক্রমাবনতি ঠেকাতে সদস্যভুক্ত দেশগুলো দফায় দফায় মিটিং করেছে, বিতর্ক হয়েছে ইউনিয়নভুক্ত বড় দেশ জার্মান-ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে, তবে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়নি। বছর কয়েক আগে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তার প্রভাব পড়ে ইউরোপীয় অর্থনীতিতেও। ইউরোপের অনেক দেশের সরকার ওই সময় থেকেই কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর জোর দিয়ে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) স্তর বৃদ্ধি এবং অবসরে যাওয়ার সময়সীমা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছরসহ নানা পদক্ষেপ নেয়, অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশগুলোর জনগণের নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকারগুলো জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল, ঋণবিদ্ধ ঘাটতি বাজেট ঠেকাতে এর বিকল্প নেই। তবে এ সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে ইউরোভুক্ত সব দেশ সমান দক্ষতা দেখাতে পারেনি তাদের জনপ্রিয়তা হারানোর আশঙ্কায়।
আজ গ্রিস ও আয়ারল্যান্ডের যে অর্থনৈতিক সংকট বা নিজস্ব তহবিল থেকে বৈদেশিক ঋণ শোধে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা এবং ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালের অর্থনীতির যে নাজুক অবস্থা, তাতে ওই সব দেশের সরকারগুলোও বহুলাংশে দায়ী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকেরা যে সামাজিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন, ওই সামাজিক বাজার অর্থনীতি নানা ধাক্কা সামলে ইউরোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি তখনই সফল হয়, যখন দেশে শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার সুরক্ষা ও ফিরিয়ে দেওয়ার আইন থাকে। অধিকারপ্রাপ্ত শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে। এটা জার্মানির ব্যতিক্রমী সফল মডেল। জার্মান অর্থনীতি মূলত রপ্তানিনির্ভর। তবে বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে জার্মানির সুযোগ-সুবিধা আর আগের মতো নেই। তার পরও জার্মান অর্থনীতি সংকট উত্তরণ করে ইউরোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানে রয়েছে।
সংকটে পড়া ইউরোভুক্ত দেশ গ্রিস ও আয়ারল্যান্ডে ঘাটতি বাজেট বা ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট করতে যে অতিরিক্ত সুদের ইউরো বন্ডের ঋণ গ্রহণ, যেখানে জার্মানিরা বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে এবং অতিরিক্ত সুদের মাধ্যমেই। তাতে জার্মানরা সমালোচিত হলেও এটা বলাই বাহুল্য, এই ঋণের পয়সা জার্মান শ্রমিক ও জনগণের ঘাম ফেলা পয়সা। তাই তারা তাদের ঋণের নিশ্চয়তা চাইবেই।
সারা বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে ইউরোপে নানা বিতর্কের পর ১৬ ডিসেম্বর ইউরোপীয় নেতারা সংকটে পড়া দেশগুলোর জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী ইউরো বন্ড ঋণব্যবস্থায় মতৈক্য হয়েছেন। সংকট কাটাতে আলোচনা আর সহাবস্থানের যে বিকল্প নেই এবং এই ধারা যে এ মহাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা আবারও প্রমাণ করলেন ইউরোপীয় নেতারা।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.