জ্বালানি-বিদ্যুৎ-সংকটের অন্তরালে by এম এ তসলিম

দেশের বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। সরকার প্রায়ই দাবি করছে যে গত তিন বছরে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির দারুণ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া শুরু না হতেই লোডশেডিংয়ের তীব্রতা এবং সব শিল্পকারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত পরিস্থিতির কোনো উন্নতির স্বাক্ষর বহন করে না। এখন অর্থমন্ত্রী বলছেন যে সরকারের বিদ্যুৎ তথ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে।


এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুতের ঘাটতি অত্যন্ত সংকটময় হয়ে উঠেছিল। বিগত বছরে বিদ্যুতে যথেষ্ট বিনিয়োগ না হওয়ায় ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এই সংকট থেকে চটজলদি উত্তরণের জন্য নবনির্বাচিত সরকার এমন একটি পন্থার আশ্রয় নিয়েছিল, যেটা তখন সময়োপযোগী এবং সুবিধাজনক বলে মনে হয়েছিল। এটি ছিল রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে সাততাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু বাস্তবায়নের পর এটা যে অবিবেচনাপ্রসূত ও ক্ষতিকর হয়েছে, তা নিশ্চিত উপলব্ধি করা গেছে। ত্বরিত সমাধান করতে গিয়ে সরকার বিদ্যুৎ সমস্যাকে একটি পূর্ণাবয়ব বাজেট সমস্যায় রূপান্তরিত করেছে, যা এখন পুরো অর্থনীতিকেই ব্যাহত করছে। এর ক্ষতিকারক অভিঘাত আরও অনেক বছর চলবে।
রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে ব্যক্তি খাতের জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে সরকার কী দামে তাদের থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করবে এবং কী দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে, সেটা নিশ্চিত করে দেয়। যেহেতু এই নির্ধারিত দাম এবং যে দামে সরকার বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে ও যে দামে জ্বালানি তেল বিদেশ থেকে কেনে, তার মধ্যে বড় আকারের অলাভজনক পার্থক্য রয়েছে। তাই এই প্ল্যান্টগুলো সচল রাখতে সরকারকে বিরাট অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এই অর্থবছরে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিতে ব্যয় করতে হবে বলে প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই ভর্তুকির পরিমাণ মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এর চাপে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়েছে। ভর্তুকি-বিব্রত সরকার এর পরিশোধের দায়ভারের অংশবিশেষ আগামী বাজেটে ঠেলে দিতে চাইছে। এতে সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা আরও শিথিল হয়ে যেতে পারে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের সরকারি (পিডিবি) তথ্য থেকে জানা যায়, বিদ্যুতের স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতা ১৯৯০-৯১ সালে দুই হাজার ৩৯৮ মেগাওয়াট থেকে ২০০৫-০৬ সালে পাঁচ হাজার ২৭৫ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, এই ১৫ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা প্রতিবছর গড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে সর্বোচ্চ (পিক) ব্যবহারের সময় বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন এক হাজার ৬৭২ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে তিন হাজার ৮১২ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে, অর্থাৎ এ সময়ে প্রকৃত উৎপাদন গড়ে বছরপ্রতি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হারে বেড়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতা থেকে উৎপাদন আহরণের নিপুণতা এ সময়ে সামান্য বেড়েছে। যদিও ২০০৬-০৭ ও ২০০৭-০৮—এ দুই বছরে উৎপাদনক্ষমতার কোনো বৃদ্ধি হয়নি, তবু সর্বোচ্চ উৎপাদন ৮ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিপুণতা বাড়ানোর বেশ সুযোগ রয়েছে। আরও প্রণিধানযোগ্য, উৎপাদনক্ষমতা বাড়ালেই যে উৎপাদন বাড়বে, তার নিশ্চয়তা নেই।
পিডিবির বিদ্যুৎ তথ্য আরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯০-৯১ থেকে ১৯৯৫-৯৬—এই পাঁচ বছরে স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে (১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০০-০১) এই হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তার পরের পাঁচ বছরে (২০০০-০১ থেকে ২০০৫-০৬) তা কমে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায়। এ সরকারের প্রথম ৩৮ মাসের শাসনকালে স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতা লাফ দিয়ে বেড়ে ১১ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছে। আসলে এই বাড়ার বেশির ভাগই হয়েছে মাত্র এক বছরে, ২০১০-১১ অর্থবছরে, যখন রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বুনো আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
বিদ্যুতের প্রকৃত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৯৯০-৯১ থেকে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে গড়পড়তা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে এবং ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০০-০১ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে তা কমে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে। লক্ষণীয় যে বর্তমান সরকারের শাসনামলে তা মাত্র ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে, অর্থাৎ এ সময়ে স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতার যে প্রকাণ্ড উল্লম্ফন, তা প্রকৃত উৎপাদনে পর্যবসিত হয়নি বা বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ায়নি।
সুতরাং, রূঢ় বাস্তবতা হলো রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন আশানুরূপ বাড়াতে পারেনি। অবাক ব্যাপার, এ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির হার গত শতাব্দীর শেষ দশকের তুলনায়ও কম ছিল, যদিও সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো ব্যয়বহুল অসাধারণ পন্থার আশ্রয় নেওয়া হয়নি।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে যে এই বিপুল স্থাপিত বিদ্যুৎ ক্ষমতা প্রকৃত উৎপাদন বাড়াতে পারল না কেন? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিপুণতা (বা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও স্থাপিত ক্ষমতার অনুপাত) যেখানে ২০০৯-১০ সালে ছিল ৭৭ শতাংশ, সেটা ২০১০-১১ সালে ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশেনেমে গেছে। কিন্তু এই অনুপাতটিই বা কেন হঠাৎ কমে গেল? পত্রপত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে মনে হয় যে এই কারণগুলোর মধ্যে আছে: ১. পুরোনো (সরকারি) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়া, ২. বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানির অভাবে পূর্ণ উৎপাদন করতে না পারা এবং ৩. রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদনক্ষমতা যত বলা হয়েছে, আসলে তার চেয়ে কম।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, তাদের উৎপাদন ৩০ এপ্রিল ২০১০ সালে দুই হাজার ৫৫৫ মেগাওয়াট ছিল; কিন্তু এ বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি তা ৪১ শতাংশ কমে মাত্র এক হাজার ৫০৬ মেগাওয়াটে দাঁড়ায়। রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের আত্মপ্রকাশ পিডিবির উৎপাদনকে ব্যাহত করেছে বলে অনুমিত হয়। ব্যক্তি খাতের উৎপাদন এপ্রিল ২০১০ সালে নাগাদ ২৮২ মেগাওয়াটে হ্রাস পেয়েছিল, কিন্তু ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে তা বেড়ে এক হাজার ১০৩ মেগাওয়াটে দাঁড়ায়। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি তেলের বা গ্যাসের অভাবে পূর্ণ উৎপাদন করতে পারেনি। সরকার তাদের জন্য যথেষ্ট তেল ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি। মনে হয়, রেন্টাল প্ল্যান্টের ফলে জ্বালানি চাহিদা যে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাবে, তার অর্থায়ন ও লজিস্টিক সমস্যাগুলো সরকার ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি, তাই উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেয়নি। এমনকি ২০১১-১২ সালের বাজেটেও এই অর্থায়ন বা লজিস্টিক সমস্যার তেমন কোনো উল্লেখ নেই।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এ সরকারের একটি অন্যতম দুর্বল দিক বলে বোদ্ধামহলে স্বীকৃত। কিন্তু বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে সরকার যে অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। এটা এখন স্পষ্ট যে সরকার রেন্টাল পথে যাওয়ার আগে এর অর্থায়ন, লজিস্টিক এবং পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল না। এটা সরকারের বিভিন্ন বক্তব্যে ধরা পড়ে। যেমন সরকার প্রায়ই দাবি করছে যে জ্বালানি তেলের দাম অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি লাগামহীন বেড়ে গেছে এবং এ জন্য তাদের কোনো দায় নেই।
এ উক্তিটি ভবিষ্যৎ মূল্য প্রক্ষেপণে সরকারের অপরিপক্বতার পরিচয় বহন করে। প্রকৃতপক্ষে তেলের বাজারে গত দুই বছরে অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। ২০০৮ সালে তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পর ২০০৯ সালে বিশ্বমন্দার সময়ে অস্বাভাবিকভাবে কমে গিয়েছিল। এটা তেলের মূল্যের গতিপ্রকৃতির রেখাচিত্র দেখলেই সহজে বোঝা যেত এবং সে সময়কার মূল্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ মূল্য প্রক্ষেপণের ভুলটি উপলব্ধি করা যেত। নিম্নে প্রদত্ত রেখাচিত্র থেকে প্রতিভাত হয় যে এই অস্বাভাবিক সময় বাদ দিলে শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই তেলের মূল্য ক্রমে বাড়ার প্রবণতা ছিল। মূল্যবৃদ্ধির এ ধারাটি থেকে অনুমিত হওয়া উচিত ছিল যে ২০১২ সাল নাগাদ তেলের দাম এখনকার মূল্যে পৌঁছাবে। সুতরাং, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার পরিকল্পনার সময় এই সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধি সরকারের অর্থনীতিবিদ ও প্রকৌশলীদের বিবেচনায় থাকা উচিত ছিল এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া সংগত ছিল।
সরকার আরও দাবি করছে যে গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানের সংকট তৈরি হয়েছে। এটা অবশ্য সঠিক, সময় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সব স্বাভাবিক পণ্যের চাহিদাই কমবেশি বেড়ে যায়, বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ে এবং এই বৃদ্ধি মোটামুটি সঠিকভাবেই প্রাক্কলন করা যায়। যেকোনো যোগ্যতাসম্পন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পকেরই এটা জানা উচিত এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনায় ব্যবস্থা রাখা উচিত। প্রশ্ন ওঠে যে সরকার কি বিদ্যুৎ পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এ বিষয়ে জ্ঞাত ছিল না? নাকি জানা সত্ত্বেও সম্পদের অভাবে এ বৃদ্ধির বিপরীতে ব্যবস্থা নিতে পারেনি? যদি শেষোক্তটি সত্যি হয়ে থাকে, তবে আরও প্রশ্ন জাগে যে যদি সম্পদের অভাবে কমবেশি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত বিদ্যুৎ (এনার্জি) চাহিদা মেটানো না যায়, তবে সরকার কী করে ৭ শতাংশাধিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে?
স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সরকারের নির্বাচনী (নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের) ওয়াদা জনগণকে অত্যন্ত আশান্বিত করেছিল। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে সে আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে সরকার যে শুধু সমস্যা ঘনীভূত করেছে তা-ই নয়, বরং আরও কয়েকটি জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে সরকার এগুলোর দায়ভারের (ভর্তুকি) অনেকখানি মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সঙ্গে সদ্যকৃত চুক্তির শর্ত থেকে অনুমান করা যায় যে সরকারের বিদ্যুৎ উচ্চাভিলাষের মাশুল দিতে জনগণের ওপর আর্থিক চাপ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
এম এ তসলিম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান।
m_a_taslim@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.