দুই দু’গুণে পাঁচ-লাইনসংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার by আতাউর রহমান

ষাটের দশকের প্রারম্ভে ঢাকায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছিল, যেটায় অন্যতম অন্তর্ভুক্তি ছিল প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছায়াছবিটি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, থাকি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। রাতের বেলায় জানা গেল, পরদিন সকাল ১০টায় স্টেডিয়ামের বাইরে অধিষ্ঠিত ফুটবল খেলার টিকিট বুথ থেকে


মহানগর-এর টিকিট বিক্রি করা হবে; কাউকেই একটির বেশি টিকিট দেওয়া হবে না। তো খুব ভোরবেলায় উঠে দল বেঁধে গেলাম স্টেডিয়ামে, গিয়ে সেখানে লাইন লাগালাম। দুপুর ১২টায় বুথের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, আমার সামনে আর মাত্র সাত-আটজন লাইনে দাঁড়ানো; এমন সময় শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। সামনে ও পেছন থেকে বুকে-পিঠে প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে ছিটকে বেরিয়ে এলাম, আর লাইনে ঢুকতেই পারলাম না। পরদিন অবশ্য ছবিটি দেখেছিলাম বিনা টিকিটে বিনা পয়সায় বলাকা সিনেমা হলের ব্যালকনিতে আরও অনেকের সঙ্গে, হলের ম্যানেজার সাহেবের সৌজন্যে।
সে যা-ই হোক, ব্যাপারটা আমার মনে পড়ে গেল বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট কেনা উপলক্ষে বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে উৎসাহী নারী-পুরুষের সুদীর্ঘ লাইন প্রত্যক্ষ করে এবং টেলিভিশনের পর্দায় তাদের অনেককে টিকিট না পেয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখে। আর হরতালের আগের রাতে ভয়ভীতিহেতু ঢাকার রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার স্বল্পতার কারণে ধানমন্ডির মেট্রো শপিং মলের সামনের বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষারত কর্মক্লান্ত পুরুষ ও নারীদের মাইল খানেক লম্বা লাইন অবলোকন করে আমার মন বিষাদগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্বাচেভ-সংক্রান্ত সেই গল্পটিও মনে পড়ে গিয়েছিল—
গর্বাচেভের ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রৈকা’র বদৌলতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে গেল এবং বাজারে জিনিসপত্রের আকাল দেখা দিল, তখন একজন রাশান অনেকক্ষণ যাবত একটি রুটির দোকানের সামনে সুদীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে অধৈর্য হয়ে বলেছিল, ‘আর সহ্য হচ্ছে না। আমি যাচ্ছি গর্বাচেভ ব্যাটাকে গুলি করে হত্যা করতে। এই বলে সে চলে গেল, কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে শুকনো মুখে পুনরায় লাইনে দাঁড়ানোর পর প্রশ্নোত্তরে জানাল, ‘আরে, গর্বাচেভকে হত্যা করতেই তো গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে দেখলাম লাইন আরও লম্বা; তাই ফিরে এলাম।’
বাস্তবিকই আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মিশে আছে তিন অক্ষরের একটি শব্দ ‘লাইন’। লাইন কোথায় নেই? সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ভর্তির জন্য লাইন, বাস ও রেলের টিকিটের জন্য লাইন, ব্যাংকে বিভিন্ন বিল প্রদান ও টাকা উত্তোলনের জন্য লাইন, ডাক্তারের চেম্বারে লাইন, ওএমএসে সস্তায় চাল পাওয়ার জন্য নিম্নবিত্তদের লাইন, চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য লাইন, হোস্টেল ও মেসের বাথরুমে গোসলের জন্য লাইন, চুল কাটাতেও নাপিতের কাছে লাইন। কত আর বলব। লাইনে লাইনে ঘুরপাক খেতেই অনেকের জীবন নিঃশেষ-প্রায়।
বলছিলাম স্টেডিয়ামের বাইরে ফুটবল খেলার টিকিট-বুথে লাইনে দাঁড়ানোর কথা। তো এ সম্পর্কে একদা আমার এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী একটি মজার গল্প শুনিয়েছিলেন: খেলার টিকিট কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ানো এক যুবক বাদাম খাচ্ছে আর সমানে বায়ু ত্যাগ করে চলেছে। তার পেছনে লাইনে দাঁড়ানো ছেলেটি অবশেষে সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, ‘ভাই, কাজটা কি ভালো হচ্ছে?’ যুবকটি বিন্দুমাত্র লজ্জিত বোধ না করে একগাল হেসে জবাব দিল, ‘ভাই, এর থেকে আর ভালো করে তো পারতেছি না।’
আরও আছে: পাঞ্জাবি পরিহিত দুই বন্ধু সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ানো; এমন সময় অগ্রবর্তী বন্ধুর মুখভর্তি থুতু এসে গেল। সে কী করবে। লাইন ছেড়ে গেলে অসুবিধা, জনসমক্ষে মেঝেতে থুতু ফেলাও অসুবিধা। পেছনের বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতেই সে ফিসফিসিয়ে পরামর্শ ছিল, ‘সামনের পাঞ্জাবিওয়ালা লোকটির পকেটে ফেলে দে। লোকটি যদি টের পায়? এই প্রশ্নটা করতেই পেছনের বন্ধু নির্দ্বিধায় বলে বসল, ‘আরে না। আমি যে দুবার তোর পাঞ্জাবির পকেটে থুতু ফেলেছি, তুই কি টের পেয়েছিস?’
ভিন্নার্থেও ‘লাইন’ ব্যতিরেকে চাকরি কিংবা ব্যবসায়ে দ্রুত উন্নতি আশা করা যায় না। বাংলাদেশে একসময় খুব কার্যকর ছিল আর্মির লাইন ও পীরের লাইন। সে সময়ে বুদ্ধিমান যাঁরা সঠিক ক্ষণে সঠিক জায়গায় লাইন দিতে পেরেছেন, তাঁরা বিশেষ করে চাকরিতে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে গেছেন; আর আমার মতো বুদ্ধিহীন যাঁরা লাইন দিতে পারেননি, তাঁরা পিছিয়ে পড়েছেন।
এবার অন্য রকম ‘লাইন’-এর একটি গল্প পরিবেশন করছি। গল্প নয়, ওটা অ্যানেকডোটস ফ্রম ইসলাম গ্রন্থ থেকে আহরিত সত্য ঘটনা—
মধ্যযুগে আবু আলী ইবনে সিনা ওরফে আবিসেনা ছিলেন একজন নামকরা দার্শনিক ও চিকিৎসক। তিনি যখন গজনীর সুলতান মাহমুদ কর্তৃক তদীয় রাজদরবারকে অলংকৃত করার নির্দেশকে প্রত্যাহার করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তখন একদা তিনি মধ্যপ্রাচ্যের গুরগান নামক স্থানে উপনীত হলেন, যেখানকার শাসনকর্তার নাম ছিল কাবুস। তো একদিন কাবুসের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসক হিসেবে রাজপ্রাসাদে তাঁর ডাক পড়ল। তিনি দেখলেন, রোগী হচ্ছে মনমরা এক যুবক, যার নাড়ি ও পেশাব পরীক্ষা করে কিছুই পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি এমন একজন লোক চাই, যে এই ছোট্ট শহরের সব এলাকা, সব রাস্তা, সব বাড়ি ও সব বাড়ির বাসিন্দাদের চেনে।’ তেমন একজন লোক জোগাড় করে আনা হলো।
ইবনে সিনা যুবকটির নাড়িতে হাত রাখলেন এবং আগন্তুক সরবে সব এলাকার নাম বলে যেতে লাগলেন। হঠাৎ একটি এলাকার নাম বলতেই যুবকের নাড়ি একটা ঝাঁকি দিল। ইবনে সিনার নির্দেশে আগন্তুক তখন এলাকার রাস্তাগুলোর নাম ক্রমান্বয়ে বলে যেতে থাকলে একটি রাস্তার নাম উচ্চারণেই নাড়ি পুনরায় ঝাঁকি খেল। ইবনে সিনা সেই রাস্তার সব বাড়ির নাম বলতে বললেন। এবারও একই ঘটনা ঘটল, একটি বাড়ির নাম উচ্চারণেই নাড়ি পুনরায় ঝাঁকি দিল। তখন ইবনে সিনা বললেন, ‘এই বাড়ির সব বাসিন্দার নাম এক এক করে বলে যান।’ এটা করা হলো এবং এবার একটি যুবতী মেয়ের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যুবকটির নাড়ি ভীষণভাবে ঝাঁকি খেল। ইবনে সিনা তখন বললেন, এই যুবকটির লাইন ওই যুবতীর সঙ্গে। ওরা দুজনে প্রেমে পড়েছে, কিন্তু অভিভাবকদের বিশেষত শাসনকর্তা কাবুসের ভয়ে সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। এদের দুজনের হাত এক করে দিলেই রোগী সেরে উঠবে। তদন্তে সেটা প্রমাণিত হলো এবং চিকিৎসকের স্বরূপও উন্মোচিত হলো।
সুধী পাঠক, ইবনে সিনার মতো এ স্থলে আকিঞ্চন আমিও একটা ব্যবস্থাপত্র দিতে চাই। সরকার বঙ্গবন্ধুর নামে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ নিয়ে যে পেরেশানিতে আছে, তার একমাত্র প্রতিষেধক হলো—সবাই মিলে আমরা ঢাকার বর্তমান বিমানবন্দরটির নাম পুনরায় পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নামে করে দিই। আপনারা ব্যবস্থাপত্রটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন আশা করি।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.