গতকাল সমকাল-দক্ষিণ সুদান: একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র by ফারুক চৌধুরী

ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২০০২ সালে পূর্ব তিমুর বর্তমান শতাব্দীতে সৃষ্ট প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তার নয় বছর পর, ২০১১ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ সুদান আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদায় বিশ্বদরবারে আসন গ্রহণ করবে এবং তা হবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র।


সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসানে উত্তর আর দক্ষিণ সুদানের মধ্যে ২০০৫ সালে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তিরই শর্ত মোতাবেক গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ সুদানে গণভোট অনুষ্ঠিত হলো। সেই গণভোটে প্রত্যাশিতভাবেই বিপুল সংখ্যাধিক্য (শতকরা ৯৮ ভাগের বেশি) প্রায় ৪০ লাখ জনসংখ্যার দক্ষিণ সুদান উত্তর সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পক্ষে রায় দিয়েছে। যদি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে, তা হলে ওই চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ সুদান আগামী ৯ জুলাই থেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হবে। উত্তর সুদান একটি মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র আর দক্ষিণ সুদানে রয়েছে খ্রিষ্টানদের সংখ্যাধিক্য।
অস্ট্রেলিয়ার অদূরে, ভারত সাগর আর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে অবস্থিত পূর্ব তিমুর আর আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত (Land locked) দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে কমই মিল রয়েছে। দুই দেশই দরিদ্র এবং অনুন্নত; কিন্তু দুই দেশেরই রয়েছে পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা—পূর্ব তিমুরের সমুদ্রগর্ভে আর স্থলবেষ্টিত দক্ষিণ সুদানের ভূগর্ভে। তাই জ্বালানির অন্বেষণে মরিয়া হয়ে ওঠা উন্নত এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে এই দুই দেশ সম্পর্কে আগ্রহ যথেষ্ট।
সুদানে বছরের পর বছর ধরে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা সবারই জানা। উন্নত দেশগুলো; বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় তৎপরতায় ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে একটি পরিপূর্ণ শান্তিচুক্তি (Comprehensive Peace Agreement) স্বাক্ষরিত হলো। সুদানের দুই অংশের মধ্যে ছয় বছর ধরে সম্পর্ক; এই সুদীর্ঘ এবং জটিল শান্তিচুক্তিই কমবেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। হালের গণভোটটি সেই শান্তিচুক্তিরই ফসল। স্বাধীনতার পক্ষে দক্ষিণ সুদানের বিপুল গণসমর্থন প্রত্যাশিত ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আল বশির দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছেন। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট বশির দক্ষিণ সুদানের পিপলস লিবারেশন মুভমেন্টের (SPLM) নেতা জন গারাংয়ের সঙ্গে শান্তিচুক্তিটি সই করেছিলেন। তার পরই জন গারাং একটি বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন সালভা কির। তাতে অবশ্য শান্তিচুক্তি ব্যাহত হয়নি। বশির আর কির এখন যথাক্রমে উত্তর আর দক্ষিণ সুদানের প্রেসিডেন্টের ভার গ্রহণ করবেন। দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বশির বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান প্রশ্নগুলোর সুরাহা করে তিনি দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে একটি গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান।
গণভোট আর তার ফলাফল প্রেসিডেন্ট বশিরের মেনে নেওয়াই যে দুই সুদানের মধ্যে সমস্যার শেষ, তা মোটেই নয়। এখনো শান্তিকে পাকাপোক্ত করতে আরও বহু পথ এগোতে হবে। এটা বোধ করি লক্ষণীয় যে বিভাজনের ফলে দক্ষিণ সুদান আরব বিশ্ব থেকে ভূরাজনৈতিক বিচারকাঠিতে দূরেই সরে গেল—উগান্ডা, কেনিয়া আর তাঞ্জানিয়ার পাশাপাশি পরিণত হলো পূর্ব আফ্রিকার একটি অংশে। বর্তমানে দক্ষিণ সুদানের তেল সরবরাহ, রপ্তানির পাইপলাইন এবং ‘রিফাইনারি’ উত্তর সুদানে অবস্থিত। পাইপলাইনটি উত্তর সুদানের মধ্য দিয়ে লোহিত সাগরতীরের পোর্ট সুদান পর্যন্ত পৌঁছায়। এখন অবশ্য চীনের সাহায্যে ভারত সাগরতীরে অবস্থিত কেনিয়ার লামু বন্দর পর্যন্ত একটি পাইপলাইন নির্মিত হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রয়োজন রয়েছে উত্তর সুদানের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছার। বর্তমানে চীনের সঙ্গে সুদানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড় ও ব্যাপক। এ নিয়ে শক্তিশালী উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে কোথাও কোনো টানাপোড়েনের সৃষ্টি হবে না তো? তারপর রয়েছে আবেয়ি অঞ্চলটির সমস্যা। ধারণা রয়েছে যে আবেয়ি অঞ্চল তেলসমৃদ্ধ। তা ছাড়া প্রায় চার হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটারের এই অঞ্চলটি দক্ষিণ ও উত্তর—উভয় সুদানের উপজাতীয়দের গো-চারণভূমি। তাই অঞ্চলটির প্রতি আগ্রহ এবং আসক্তি উভয় দেশের উপজাতীয়দেরই রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এই অঞ্চলটির সীমান্ত চিহ্নিতকরণ এবং একটি স্থায়ী সমঝোতায় আসা একান্ত প্রয়োজন। এদিকে উগান্ডার আলবার্ট লেক অঞ্চলে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। কঙ্গোতেও খুব সম্ভবত প্রচুর ভূগর্ভস্থ তেল রয়েছে। কথা উঠেছে যে চীন হয়তো বা প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার একটি পাইপলাইন স্থাপন করে লামুর প্রস্তাবিত পাইপলাইনের সঙ্গে তা সংযোগ করে দেবে এবং সমান্তরালভাবে সেই অঞ্চলে সড়ক আর রেলসংযোগ স্থাপন করবে। সে ক্ষেত্রে উত্তর সুদানের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের গুরুত্ব হ্রাস পাবে।
কথায় বলে এবং তা বিজ্ঞানসম্মত সত্য যে তেল আর পানি মেশে না। কিন্তু একটি অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেল আর পানি নিঃসন্দেহে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ আর সেই অঞ্চলের বুক চিরে প্রবাহিত নীল নদ পূর্ব আফ্রিকার অঞ্চলটিকে গড়ে তুলতে পারে শিল্প, কৃষি এবং আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ। যদি এই অঞ্চলের দেশগুলো ধর্মীয় ও উপজাতীয় সংঘাতকে এড়িয়ে পথচলা শুরু করে, তা হলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে লিভিংস্টোন আখ্যায়িত ‘ডার্ক কন্টিনেন্ট’ অর্থাৎ অন্ধকার মহাদেশটি একবিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নের আলোতে ঝলমল করে উঠতে পারবে নিশ্চয়ই।
সুদানের বিভক্তি আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং বিশ্বের দশম বৃহত্তম রাষ্ট্রকে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত করল। বিভিন্ন কারণে ১৯৫৬ সালে সুদানের স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটির দুটি অংশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন হয়তো বা দ্বিধাবিভক্ত সুদানের পক্ষে তা সম্ভব হবে। এই বিভক্তি মৌলিকভাবেই অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে। দক্ষিণ সুদান এখন সম্ভবত পূর্ব আফ্রিকান কমিউনিটির একটি অংশ হয়ে যাবে। তবে দক্ষিণ সুদানে শান্তি বজায় রাখা একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এত দিন দক্ষিণ সুদানের উপজাতীয়দের প্রতিপক্ষ ছিল সুদান। এখন তাদের চলে যাওয়াতে দক্ষিণ সুদানের প্রায় ২০০ উপজাতীয় এবং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত বাধতে পারে। তারপর দেশজুড়ে এখন অস্ত্রের ছড়াছড়ি। সাধারণ জনসাধারণের নিরস্ত্রীকরণ দুই সুদানেই একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সাল, অর্থাৎ গণভোটের রায়ের দুই দিন পরই দক্ষিণ সুদানের পল্লি উন্নয়নমন্ত্রী জিমি মিল্লা আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না উপজাতীয় রেষারেষি-উদ্ভূত, তা দেখার বিষয়।
দুই সুদানে সরাসরি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত হয়তো বা আর সম্ভব নয়—কারণ চীন, যুক্তরাষ্ট্র মিলে বিশ্বের তেলপিপাসু রাষ্ট্রগুলো তা ঘটতে দেবে না। তবে দুই দেশের উপজাতীয় এবং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রশ্নটি এক অর্থে আরও বেশি জটিল। যেমন—দক্ষিণ সুদানের মুক্তিবাহিনীতে প্রধানত দুটি উপজাতীয় গোষ্ঠী রয়েছে—ডিংকা আর নুয়ের। তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথার মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ সুদান সফর শেষে ডিংকা উপজাতির বৈশিষ্ট্যের কথা লিখেছিলাম। ডিংকা রমণীদের সৌন্দর্য তাদের উচ্চতায়। আমার মনে পড়ে, দক্ষিণ সুদানের জুবাতে ব্র্যাকের একটি কর্মিসভায় দীর্ঘকায়া ব্র্যাকের একজন কর্মী আমাকে বলেছিলেন, বিয়ের বাজারে তাঁর যৌতুক ২০০ গরু। গত ৮ জানুয়ারি খবর নিয়ে জানলাম, মেয়েটি আর ব্র্যাকে কর্মরত নেই। তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। ২০০ গরুর মূল্যে ব্র্যাকের পক্ষে এই কর্মঠ সুদর্শনা মেয়েটিকে বোধ করি ধরে রাখা সম্ভব ছিল না!
দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রশংসনীয় কাজ করছে। তা নিজের চোখে দেখেছি এবং বাংলাদেশি হিসেবে গর্বিত অনুভব করেছি। সেই শান্তিরক্ষী বাহিনীর সামনে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে; বিশেষ করে, দক্ষিণ সুদানে উপজাতীয় এবং বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে যদি সংঘাতের সৃষ্টি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ, কর্মঠ, সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এখন বিপুল অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। আমাদের শান্তিবাহিনীর সদর দপ্তর জুবার সন্নিকটে, তবে দক্ষিণ সুদানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যথা—মারিদি, তরিত, ইয়েই ইয়েমবিওরের মতো বিচিত্র সব নাম না-জানা স্থানে রয়েছে তাদের অবস্থান। তাদের দেখে এসে এই বিশ্বাস আমার জন্মেছে যে, যেকোনো প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে।
২০০৭ সাল থেকে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক দক্ষিণ সুদানে কর্মরত। গত তিন বছর দক্ষিণ সুদানে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বিস্তৃতি লাভ করেছে। দক্ষিণ সুদানের ৮৪টি কাউন্টির মধ্যে নয়টিতে ব্র্যাক এ পর্যন্ত প্রায় ৭৬ লাখ আমেরিকান ডলারের ক্ষুদ্রঋণ দিয়েছে এবং এসব ঋণের গড়পড়তা পরিমাণ হচ্ছে ২২৪ আমেরিকান ডলার। কৃষিক্ষেত্রে ব্র্যাকের ইজারা নেওয়া জমি রয়েছে এবং এ পর্যন্ত দুই হাজার ৪০০ কৃষককে ব্র্যাক আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে শিক্ষা দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ব্র্যাক প্রায় দেড় লাখ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়েছে। দক্ষিণ সুদানে ব্র্যাকের ১৫০টি স্কুলে প্রায় চার হাজার ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে।
গত ৮ জানুয়ারি আমি দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবাতে দক্ষিণ সুদানে ব্র্যাকের নির্বাহী কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিককে টেলিফোন করেছিলাম। দক্ষিণ সুদানে ব্র্যাকের ৪৪৭ জন কর্মী রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৪১ জন বাংলাদেশি; বাকিরা সব দক্ষিণ সুদানের। তিনি আমাকে জানালেন, গণভোটের ফলাফলের পর দক্ষিণ সুদানের কর্মীদের মধ্যে আনন্দের উচ্ছ্বাস বইছে এবং তিনি তাদের কাজে নতুন উৎসাহ আর উদ্যম লক্ষ করছেন। তিনি আমাকে জানালেন যে আমার সফরের পর গত আড়াই বছরে জুবা ও দক্ষিণ সুদানের অন্যান্য অনেক স্থানের চেহারাই পাল্টে গেছে। রাস্তাঘাট, যাতায়াতব্যবস্থা আর হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদির হয়েছে প্রভূত উন্নতি। এই জুবাকে আপনি এখন চিনতেই পারবেন না।—পরম তৃপ্তিতে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন ব্র্যাকের সদর অফিসে আমার একদার সহকর্মী এবং দক্ষিণ সুদানে ব্র্যাকের বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা (Country Representative) আবু বকর সিদ্দিক।
দক্ষিণ সুদানের আগামীর পথ সম্ভাবনাময়, কিন্তু কণ্টকশূন্য নয়। ক্রিকেটের ভাষায় জ্যেষ্ঠতার ‘লিগ টেবিলে’ বাংলাদেশ বিশ্বের ১৯৩তম দেশ দক্ষিণ সুদানের অনেক ওপরে। এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে নীল নদবিধৌত শ্যামল এবং অমিত সম্ভাবনাময় সেই দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিস্তৃতি লাভ করুক, এটাই আন্তরিকভাবে কামনা করি।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.