সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশের সমাজভূমি ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম by বদরুদ্দীন উমর

বর্তমানে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতি ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা দেখা যাচ্ছে সে অচলাবস্থা দূর করার জন্য বিদ্যমান সমাজভূমির দিকে তাকাতে হবে। এই সমাজভূমি পরিবর্তনের জন্য লড়তে হবে। এ লড়াই কোনো সাংবিধানিক লড়াই নয়, একের পর এক 'নিরপেক্ষ' নির্বাচনের লড়াই নয়।


এই লড়াই যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশে রাজনীতির সব থেকে গ্রাহ্য ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কোনো প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তন তো সম্ভব নয়ই, এমনকি জনগণের পক্ষে এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখারও কোনো সম্ভাবনা নেই



বাংলাদেশে চুরি, দুর্নীতি, ঘুষখোরি, খুন-খারাবি থেকে নিয়ে শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক খেয়োখেয়ি পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যে স্থূলতা (পৎঁফরঃু) যেভাবে দেখা যায় এটা অন্য দেশে দেখা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেলেও এই স্থূলতা এত সর্বগ্রামী কোথাও নয়। স্থূলতা এমন এক জিনিস যা মানুষের আচরণ থেকে শুধু সততা নয়, লজ্জা-শরম, অন্যের প্রতি সামান্যতম বিবেচনা পর্যন্ত সবকিছুই বিসর্জন দেয়। এটা বলাবাহুল্য যে, স্থূল ব্যক্তি সংস্কৃতির কোনো উচ্চমার্গের বাসিন্দা নয়। তার বসবাস অতি নিম্ন চরিত্রের সংস্কৃতির সঙ্গে।
এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ আজ যেসব সমস্যার দ্বারা জর্জরিত, সেগুলো তার অস্তিত্বের গভীর দেশেই তৈরি হয়েছে। এ কারণে সর্বক্ষেত্রেই আচরণের স্থূলতার যে কথা বলা হয়েছে সেগুলো একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
স্থূলবুদ্ধির একটা পরিচয় এই যে, সে কখন কী বলে ও করে তা খেয়াল করতে পারে না বা পরোয়া করে না। কাজেই তার আচরণের মধ্যেও কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। সমাজ বা রাজনীতির উচ্চ আসনে এ ধরনের লোক যদি অধিষ্ঠিত থাকে, তাহলে নিজের পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ কী হওয়া উচিত এ বিষয়েও তার ধারণা থাকে না। এখানে এসব কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, বাংলাদেশে আজ যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই এ স্থূলতা দৃষ্টিগোচর হয়। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর সমগ্র অংশই স্থূলতাপ্রাপ্ত হয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশকে এই চরিত্র দোষে দূষিত করেছে।
১৯৭১ সালের ঠিক পর থেকেই অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই সমাজের অপরাধিকীকরণ বেশ হঠাৎ করেই দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর শুরু শাসকশ্রেণীর উচ্চস্তরে সরাসরি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের দ্বারা, সরকারের সঙ্গে নানা সূত্রে সম্পর্কিত লোকদের দ্বারা। এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ছিল না। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল হঠাৎ করে স্বাধীনতার পরমুহূর্তেই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকজনের সামনে আদিগন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার ফলে। এই সম্ভাবনা তাদের মধ্যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাগিদ সৃষ্টি করেছিল লুটপাটের। তারা নিজেরা সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না, যা কিছু তাদের আয়ত্তের মধ্যে এসেছিল সেটা তাদের দ্বারা উৎপাদিত হয়নি। অন্যের উৎপাদিত সম্পদ হাতের কাছে পেয়ে তারা লুটপাট করেছিল। লুটপাট হচ্ছে ধনসম্পত্তি অর্জনের নিকৃষ্টতম পথ। ভালো কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের চরিত্র যেমন উচ্চতাপ্রাপ্ত হয়, পরিশীলিত হয়, তেমনি খারাপ কাজ মানুষের চরিত্রের অবনতি ও অধঃপতন ঘটায়। স্বাধীনতার জন্য যথাযথভাবে রাজনৈতিকভাবে তৈরি না হওয়ায় হঠাৎ স্বাধীনতা বাংলাদেশের লোকদের, বিশেষত শাসকশ্রেণীর লোকদের সামনে যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছিল, সেই সম্ভাবনা এ দেশের জন্য কল্যাণকর না হয়ে অকল্যাণের পথই প্রশস্ত করেছিল। এটা ঠিক যে, ধনসম্পদের দিক দিয়ে, সার্বিকভাবে উৎপাদনের দিক দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতির প্রক্রিয়ার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে এর জন্য বাংলাদেশের জনগণকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা অসামান্য, তার হিসাব দাঁড় করানো এক কঠিন সাধ্য ব্যাপার।
প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলে বোঝা যায়, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় যে মধ্য শ্রেণী গঠিত হয়েছিল, শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সংগ্রামের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, এক কথায় সামগ্রিকভাবে যে সমাজ তৈরি হয়েছিল তা ভেঙে চুরমার হয়েছে। পূর্ববর্তী সমাজের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যে সমাজ এখন খাড়া হয়েছে এর সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সংস্কৃতির নিম্নমানতা, নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, মানুষের প্রতি মানুষের বিবেচনার চরম অভাব, অনাড়ম্বর ও মিথ্যাচরণের প্রাধান্য এবং এসব মিলিয়ে সমাজের বিরাট অংশের অপরাধিকীকরণ। শুধু তাই নয়, একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ওপরে যেসব নেতিবাচক দিকের উল্লেখ করা হলো, তার প্রত্যেকটির নিয়মিত বৃদ্ধি। বাংলাদেশে যেভাবে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, সেভাবেই বৃদ্ধি হচ্ছে সমাজের অপরাধিকীকরণের মাত্রা! এর শেষ কোথায়, এ প্রশ্ন এখন সকলের সামনে।
সমাজের ওপর তলায় যা ঘটে, শাসকশ্রেণী ও তার সরকার যে শাসন পরিচালনা করে ও যেভাবে সেটা করে, তার প্রভাবেই সামগ্রিকভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয়। বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ছাড়া অন্য সময়ে এটাই হলো সাধারণ নিয়ম। বাংলাদেশে কোনো বৈপ্লবিক পরিস্থিতির অনুপস্থিতিতে এই সাধারণ নিয়ম অনুযায়ীই সমাজ পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থা যে কত ভয়াবহ এটা শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলো ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর আচরণের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এদিক দিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ দাঁড়িয়েছে এ কারণে যে, বাংলাদেশ এখন ব্যবসায়ীদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। আগে যেখানে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেন, রাজনৈতিক দলগুলো অনেকাংশে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করত, সেখানে আজ ব্যবসায়ীরা নিজেরাই সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখল করে নিজেদের স্বার্থ সামাল দিচ্ছেন! অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন ব্যবসায়ীরাই রাজনৈতিক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে! বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিপুল অধিকাংশ সদস্য। আশি শতাংশের ওপরই এখন ব্যবসায়ী। অন্যদেরও বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত!
কোনো দেশে ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তার পরিণতি সমাজের জন্য কী দাঁড়ায় কার্ল মার্কস তার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'পুঁজি'র তৃতীয় খণ্ডে। তিনি সেখানে বলেছেন, 'গবৎপযধহঃং পধঢ়রঃধষ, যিবহ রঃ যড়ষফং ধ ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ফড়সরহধহপব, ংঃধহফং বাবৎু যিবৎব ভড়ৎ ধ ংুংঃবস ড়ভ ৎড়ননবৎু, ংড় ঃযধঃ রঃং ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ধসড়হম ঃযব ঃৎধফরহম হধঃরড়হং ড়ভ ড়ষফ ধহফ সড়ফবৎহ ঃরসবং রং ধষধিুং ফরৎবপঃষু পড়হহবপঃবফ রিঃয ঢ়ষঁহফবৎরহম, ঢ়রৎধপু, শরফহধঢ়ঢ়রহম ংষধাবং, ধহফ পড়ষড়হরধষ পড়হয়ঁবংঃ,' (ঈধঢ়রঃধষ াড়ষ ররর, ঢ়. ৩৩১, ১৯৬৬). ব্যবসায়ী পুঁজি সমাজে প্রাধান্যে হলে চারদিকে লুটতরাজ, দস্যুতা, অপহরণ ইতাদি ঘটতে থাকার যে কথা ওপরের উদ্ধৃতিতে মার্কস বলেছেন তার আধুনিকতম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। ১৯৭২ সাল থেকে অনুৎপাদক শ্রেণীর লোকজন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ব্যাপক লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধনসম্পদ অর্জন করে যেভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণীতে পরিণত হয়ে সমগ্র সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করেছে ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এর মধ্যে মার্কসের উপরের বক্তব্যের সঠিকতা ও সত্যতাই নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সাল পূর্ববর্তী এ দেশের সমাজ ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী পুঁজি কর্তৃক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ভূমিকা সম্পর্কে এখানে কোনো চিন্তাভাবনা আজ পর্যন্ত শাসকশ্রেণীর গবেষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখা যায়নি। এই শ্রেণীবৃত্তের বাইরে এ বিষয়ে যে চিন্তাভাবনা হয়েছে সেটাও হিসাবের মধ্যে নেওয়ার প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ববর্তী সমাজ ভেঙে পড়ে যে নতুন সমাজ গঠিত হয়েছে, তার চরিত্রের ভয়াবহতা এখন সকলের চোখের সামনে থাকলেও এর কারণ সম্পর্কে খুব অল্প লোকেরই হয়তো কিছু ধারণা আছে। সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকায় এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের উপায় কী, এ নিয়ে বিশেষ কারও কোনো ধারণা আছে মনে করার কারণ নেই। তাছাড়া যারা বিদ্যমান শাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত, বহু বিচিত্রমুখী লুটতরাজের যারা ফলভোগী, তারা এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের বিরোধী। অন্যদিকে ৪০ বছর ধরে এই শ্রেণীশাসন পুরনো সমাজ ভেঙেচুরে দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তার ও আচরণের যেসব অভ্যাস তৈরি করেছে, যার কিছু উল্লেখ এ আলোচনার শুরুতে করা হয়েছে, সেটাও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ। সংস্কৃতি ও রাজনীতির শীর্ষ দেশ থেকে নিয়ে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত এই বাধার দেয়াল কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে এ নিয়ে গুরুতর কোনো চিন্তাভাবনা না হলেও এটাই মূল কারণ যে জন্য বাংলাদেশে আজ গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল, বিপ্লবী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ কর্মীর এত দুর্ভিক্ষ। যে সমাজভূমি থেকে এ ধরনের কর্মীরা বিপ্লবী পরিবর্তনের তাগিদে আবির্ভূত হন আজকের বাংলাদেশের সমাজভূমি সে রকম নয়। কাজেই বর্তমানে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতি ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা দেখা যাচ্ছে সে অচলাবস্থা দূর করার জন্য বিদ্যমান সমাজভূমির দিকে তাকাতে হবে। এই সমাজভূমি পরিবর্তনের জন্য লড়তে হবে। এ লড়াই কোনো সাংবিধানিক লড়াই নয়, একের পর এক 'নিরপেক্ষ' নির্বাচনের লড়াই নয়। এই লড়াই যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশে রাজনীতির সব থেকে গ্রাহ্য ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কোনো প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তন তো সম্ভব নয়ই, এমনকি জনগণের পক্ষে এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
১৮.৭.২০১১

No comments

Powered by Blogger.