বাংলা নববর্ষের সংস্কৃতি ও বহুজাতিক কম্পানি by ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে আমাদের বছর-পরম্পরার অনুশীলন, নানামাত্রিক বহু-ব্যঞ্জনার উৎসব-আয়োজন, গ্রামবাংলার মানুষের প্রাণোচ্ছল পিঠা-পার্বণের পসরা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাহারি বৈশাখী মেলা, হালখাতা খোলার ঐতিহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা, শহরে-মফস্বলে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কসরত, নগরকেন্দ্রিক নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা


এবং প্রিন্ট মিডিয়ার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আনুষ্ঠানিকতার প্রাবল্য নববর্ষের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ছায়ানট, রমনা বটমূল, মঙ্গল শোভাযাত্রা, লাল-সাদা রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি, চতুর্দিকে নানা রকম ফুল ও রঙের ছড়াছড়ি, পান্তাভাত ও ভাঁজা ইলিশ এবং ভেঁপু-বেহালা-ঢোল-মৃদঙ্গসহ বিভিন্ন ধরনের বাধ্যযন্ত্রের পোঁ-পোঁ শব্দে চতুর্দিকে একটা উৎসবের আমেজ আমরা লক্ষ করি। এ সবকিছুই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বৈশিষ্ট্য, যা ইতিমধ্যে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন এখন শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের মাঝে একটি সপরিবারে বিনোদনের দিন হয়ে উঠেছে। তবে, ক্রমবর্ধমান হারে মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি নববর্ষের যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য, সেটাকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিচ্ছে। মিডিয়ার প্রবল জোয়ারে ভেসে পুরো নববর্ষের আবেগটি ইদানীং কেমন যেন 'পণ্য' হয়ে ওঠার পাঁয়তারা করছে। বহুজাতিক কম্পানিগুলোর স্পন্সরে আমাদের নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা যে হারে সের দরে বেচা-বিক্রি হয়, তাতে তা 'ইতিমধ্যেই পণ্য হয়ে উঠেছে'_এই দাবি কেউ করলে গোস্সা করার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকবে না। আমাদের ব্যক্তিজীবনে লোভ-লালসা-দুর্নীতির বেপরোয়া বিস্তার, সমাজজীবনের অতলতার ও অগভীরতার যে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, তার গিরিচাপে পড়ে বাঙালির হাজার বছরের সাধ ও সাধনার এই নববর্ষ এবং এর আবেগ-অনুভূতি কেমন যেন ক্ষীণ হয়ে উঠছে। উত্তর প্রজন্মের কাছে নববর্ষ হয়ে উঠছে একটি সরকারি ছুটির দিন, বেসরকারি টেলিভিশনে লাল-নীল-গোলাপি অনুষ্ঠানের দিন, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠ-বস করার দিন আর বহুজাতিক কম্পানিগুলোর কাছে নিজেদের 'পণ্য' ও 'সেবা'র বেপরোয়া প্রচারের দিন। এই আনুষ্ঠানিকতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে উত্তরপ্রজন্মের কাছে নববর্ষ উদ্যাপনের ঐতিহ্যিক মাহাত্ম্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এবং দেশপ্রেমের যে সুগভীর চেতনা, তা ক্রমান্বয়ে বেগানা হয়ে উঠছে। তাই আমাদের নববর্ষের তাৎপর্য এবং এর যে মাহাত্ম্য, প্রভাব ও প্রণোদনা, ব্যক্তিজীবনে আমরা আর তা সেভাবে বোধ করি না। ফলে আমরা হয়ে উঠেছি স্বার্থপর, লুটেরা এবং দেশপ্রেমহীন ভোগবাদী একটি সমাজের সুবিধাবাদি ও স্বার্থপর নাগরিক, যা নববর্ষের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাম্যবাদের তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য, তার সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক ও বিপ্রতীপ। এখানে এসেই নববর্ষ উদ্যাপনের সংস্কৃতির সঙ্গে বহুজাতিক কম্পানির নেতিবাচক সম্পর্ক উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে।
হাজার বছরের উত্তরাধিকার হিসেবে বাঙালি ব্রাত্যজনের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে স্বতন্ত্র একটি সাংস্কৃতিক মণ্ডল, যাকে পরিপুষ্ট করেছে আর্য-অনার্য সংস্কৃতি, মোগল-পাঠান, ফারসি-উর্দু, সুফি-সাধকের জীবন-দর্শন, বাউল-বৈরাগী ও মুর্শিদী জীবনাচার। এ দেশের গ্রামবাংলার শত উৎসব-মেলা, পিঠা-পার্বণ, হস্তশিল্প, বরণশিল্প, সংগীত-কলা, ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, জারি-সারি, বিচিত্র রূপকথা ও প্রবাদ-প্রবচন বাঙালি সংস্কৃতিকে করেছে ঐতিহ্যমণ্ডিত, সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং শৌর্যশালী। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির আবহে তৈরি হওয়া ব্রাত্যজনের এই জীবনাচার ও জীবনদর্শন উত্তরকালেও আমরা যথাযথ মর্যাদায় সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে আমাদের হৃদয়ে লালন-পালন করার একটি রীতি-রেওয়াজ তৈরি করেছি। প্রতিবছর ইংরেজি ১৪ এপ্রিল 'বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন' একটি বার্ষিক জাতিগত উৎসবের রূপ ধারণ করেছে। ইহজাগতিক নানা ব্যবস্থার জন্য কিংবা গোলকায়নের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে মত্ত একটি বিদঘুটে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও বছরের অন্তত একটি দিন, বাংলা নববর্ষের দিন বাঙালিপনায় মেতে ওঠে। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, একান্ত নিজস্বতার খোঁজে এবং জাতিসত্তার টানে বছরের অন্তত একটি দিন পুরাদস্তুর বাঙালি হয়ে ওঠার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা আমাদের নববর্ষ উদ্যাপনের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাঙালির এই উৎসবপ্রবণতার সুযোগে, বাঙালি হয়ে ওঠার অদম্য ইচ্ছার ফাঁকে বেশ চতুরতার সঙ্গে ঢুকে পড়েছে বহুজাতিক কম্পানি। বহুজাতিক কম্পানিগুলোর এই ঢুকে পড়া কেবল অনাহূত কোনো অতিথির ভুল-বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে আসা নয়, বরং একেবারে বেনিয়া মনোবৃত্তির সুকৌশল অনুপ্রবেশ, যাকে রাজনৈতিক শব্দমালায় বলা হয় 'আগ্রাসন'। বহুজাতিক কম্পানির এই আগ্রাসন ইতিমধ্যে ক্রমান্বয়ে গিলে খেয়েছে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রাজন্মিক দেশাত্ববোধ। এখন এটা জেঁকে বসেছে বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপর।
বহুজাতিক কম্পানির এই আগ্রাসী কর্মপরিকল্পনাকে পরিপুষ্ট করছে এ দেশেরই একটি শিক্ষিত ও দেশপ্রেমহীন স্বার্থপর বণিক শ্রেণী। যাদের নিরন্তর মুনাফান্বেষী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক কম্পানির স্বার্থপর বেনিয়ারা সুকৌশল-প্রকৌশলে নববর্ষের সংস্কৃতিকে কিংবা সংস্কৃতি উদ্যাপনের রেওয়াজকে দেশপ্রেম বিবর্জিত একটি হৈ-হুল্লোড়মাখা উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছে, যাতে নতুন প্রজন্মকে দেশীয় সংস্কৃতি-বিযুক্ত করে দেশাত্ববোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়। কেননা, এ দেশের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি হচ্ছে ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাস ও লাভালাভের ঊধর্ে্ব উঠে সমষ্টিগতভাবে ভালো থাকার সংস্কৃতি। বেনিয়ার দর্শন হচ্ছে মানুষকে মুনাফামুখী ও ভোগবাদী করে গড়ে তোলা, যাতে মানুষকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে সমষ্টিগতভাবে সুখে থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে ব্যক্তিগত লাভালাভের চিন্তায় মগ্ন রাখা যায়, যাতে বেনিয়ার মুনাফা লাভের প্রকল্প সফল হয়। নতুন প্রজন্মকে নববর্ষ উদ্যাপনের অন্তরালে যে সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের স্পিরিট থাকে, তা থেকে সুকৌশলে বিযুক্ত করা মানেই বহুজাতিক কম্পানির পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত করা। নতুন প্রজন্মের কাছে বাঙালি নববর্ষ উদ্যাপনকে একটি শৌর্য-বীর্যহীন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করা মানেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাকে বিনষ্ট করা। এটাই নববর্ষ উদ্যাপনের সংস্কৃতির ডামাডোলে বহুজাতিক কম্পানির ভয়ংকর আগ্রাসন। তাই আমাদের সবার নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপনের সামগ্রিক আয়োজনকে বহুজাতিক কম্পানির রাহুমুক্ত করা। এর সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ফিরিয়ে দেওয়া এবং নববর্ষ উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিকতাকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার সাংস্কৃতিক প্রেষণা তৈরি করা। বহুজাতিক কম্পানির আগ্রাসনমুক্ত এবং মিডিয়ার মুনাফামুখী নিছক আনুষ্ঠানিকতার ঊধর্ে্ব উঠে সত্যিকারের বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক প্রাণ-প্রাচুর্যে পূর্ণ একটি নববর্ষ উদ্যাপনের সংস্কৃতি নির্মাণের মধ্য দিয়েই তৈরি করা সম্ভব একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতন। এটাই হোক আজকের বাঙালি নববর্ষের নব-অঙ্গীকার।
লেখক : গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.