অর্থনীতি-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও নতুন ব্যাংক by খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

বর্তমানে যে প্রায় অর্ধশত ব্যাংক কাজ করছে, তাদের সবার পারফরম্যান্স আশানুরূপ নয়। ইচ্ছাকৃত নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডও তুলনামূলক কম। সবাই চলতে চাইছে প্রচলিত ছকবাঁধা পথে। নতুন ব্যাংকগুলো কি এ ধারার বাইরে যেতে পারবে? তারা রাজনৈতিক প্রভাবের ফসল


বাংলাদেশে আরও ৯টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্য এ বিষয়ে অভিন্ন মতে ছিলেন না বলে সংবাদপত্রের খবরে জানা গেছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে তারা লাইসেন্স পাবে। এ সময়ের মধ্যে শর্তগুলোর অধিকাংশ পূরণ করতে হবে। নতুন ব্যাংকের মধ্যে তিনটির উদ্যোক্তা প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে এর পেছনে সরকারের রাজনৈতিক মতামত গুরুত্ব পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনটি ঘটে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-স্বাধীনতা হয়তো যথাযথভাবে রক্ষা করা যায়নি। তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাতে সায় মিলছে না। অতীতেও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি এবং মোট মূলধন ৮০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। পরিশোধিত মূলধনের পুরোটাই বৈদেশিক মুদ্রায় করতে হবে। তাদের সভরেন বন্ড বিক্রির শর্ত দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে, এমন কথা বলা হচ্ছে। তারপরও নতুন ব্যাংক স্থাপন কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন কেউ করতেই পারে।
এ ক্ষেত্রে একটি যুক্তি দেওয়া হয় যে, এক যুগেরও বেশি সময় পর বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে। জিডিপি দ্বিগুণ হয়েছে। গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা যে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা সত্ত্বেও ৬ শতাংশের ওপরে থাকছে, তার মূলে রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষি খাত। খাদ্যশস্যে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রবাসীরা যে নিয়মিত অর্থ পাঠাচ্ছে তারও বড় অংশ সরাসরি যায় গ্রামে। এ অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হয়। ক্ষুদ্রঋণও লাখ লাখ নারী-পুরুষকে অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করছে। এ ঋণ বিতরণের সঙ্গে কয়েকটি সংস্থা একেবারে মানুষের দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে। সে তুলনায় ব্যাংকিং খাত অনেক অনেক পিছিয়ে।
বিদ্যমান অবস্থায় আর্থিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং সুবিধা অন্যতম। এখন যেসব ব্যাংক কাজ করছে তাদের শাখা বাড়িয়ে এ কাজ করা যেতে পারে। শহরগুলোতে অবশ্যই শাখা বাড়ানো যায়, তাবে বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলেই সম্ভাবনা বেশি। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ৩৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরের মতিঝিল, গুলশান ও ধানমণ্ডির শাখাগুলোর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। রমনা, তেজগাঁও ও উত্তরা থেকে পাওয়া যায় আরও প্রায় ১০ শতাংশ আমানত। আর অগ্রিমের ৪০ শতাংশের বেশি দেওয়া হয় মতিঝিল ও গুলশানের শাখাগুলো থেকে। দেশের অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর চট্টগ্রাম আমানতের অপর গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এ নগরীর ডবলমুরিং ও কোতোয়ালি থেকে আসে ৮ শতাংশের বেশি আমানত। অগ্রিমেও বন্দরনগরীর এ দুটি থানার হিস্যা ১৫ শতাংশের বেশি।
দেশে ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যাংক সক্রিয় রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় চেষ্টায় দেশে প্রায় এক কোটি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সরকার কৃষকদের সীমিত যে আর্থিক সুবিধা বা ভর্তুকি দেয় তা এসব অ্যাকাউন্টে সরাসরি চলে যায়। হিসাব খোলার জন্য কৃষকদের মাত্র ১০ টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যয় হয়েছে অনেক বেশি। দেশের সর্বত্র হাজার হাজার গ্রামের কৃষক এভাবে ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাতে আমানত বা ঋণ-অগ্রিমে তেমন হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে, সেটা স্পষ্ট। গ্রামীণ অর্থনীতিও বদলে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তার প্রতিফলন নেই। সিলেট আমানত সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। এর কারণ প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ। ঐতিহ্যগতভাবে এ এলাকার বিপুলসংখ্যক লোক ব্রিটেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ২ শতাংশ আসে সিলেট সদরের বিভিন্ন ব্যাংক শাখা থেকে। কিন্তু এ এলাকা থেকে অগ্রিম দেওয়া হয় ১ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ যত আমানত, ঋণ তার অর্ধেকও নয়। সিলেটের অন্যান্য শাখাতেও প্রায় একই চিত্র। নতুন ব্যাংকগুলোকে শহরে একটি শাখার বিপরীতে গ্রামে একটি শাখা স্থাপনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। গ্রামের জন্য এটা একের পরিবর্তে দুই বা তিনও করা যেতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য গ্রামে শাখা স্থাপনের শর্ত এখনও রয়েছে। সেটা মানা হচ্ছে না। নতুন ব্যাংকগুলো এ শর্ত মানবে তো? তারা কিন্তু রাজনীতির শক্তিতে অনুমোদন পেয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করা হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। এখন যেসব ব্যাংক সক্রিয় রয়েছে গ্রামে তাদের শাখা আরও বাড়ানোর কাজ নতুন ব্যাংকগুলোর জন্য তুলনামূলক সহজ হতো। তাদের প্রশাসনিক কাঠামো মোটামুটি মজবুত এবং সব ব্যাংকই যথেষ্ট লাভ করছে। কিন্তু নিয়মবিধি ও আইন মানানোর জন্য কি যথেষ্ট চেষ্টা চালানো হয়েছে?
বিদ্যমান বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর ফোকাস এক নয়। কেউ করপোরেট বাণিজ্য প্রাধান্য দিচ্ছে। কেউবা রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা আমানতের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু শিল্প ও বাণিজ্যিক এবং সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক কম সুদে ঋণ প্রদানের জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হয় তাদের, এমন চিত্র কার্যত অনুপস্থিত। ঋণ ও আমানতের সুদের হারে পার্থক্য বছরের পর বছর বেশ বড় অঙ্কে থাকছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ সত্ত্বেও তা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সুদের হার কমানো ও সেবার মান বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নতুন ব্যাংকগুলো কার্যক্রম শুরু করলে এ প্রতিযোগিতায় ইতিবাচক নতুন মাত্রা আসবে, এমন সম্ভাবনা দেখি না; কিন্তু আমানত সংগ্রহের জন্য প্রতিযোগিতা যে তীব্র হবে তাতে সন্দেহ নেই।
নতুন ব্যাংকগুলো ঢাকার বাইরে সদর দফতর খুললে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের যুগে এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও দক্ষভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এতে বরং প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু কোনো ব্যাংক কি এ সুবিধা গ্রহণ করবে? এটাও ভালো হয় যদি ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে অর্থনীতির বিভিন্নম্ন খাতকে ঋণ প্রদানে অগ্রাধিকারের জন্য ভাগ করে নেয়।
সব শেষে বলব আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার কথা। বর্তমানে যে প্রায় অর্ধশত ব্যাংক কাজ করছে, তাদের সবার পারফরম্যান্স আশানুরূপ নয়। ইচ্ছাকৃত নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডও তুলনামূলক কম। সবাই চলতে চাইছে প্রচলিত ছকবাঁধা পথে। নতুন ব্যাংকগুলো কি এ ধারার বাইরে যেতে পারবে? তারা রাজনৈতিক প্রভাবের ফসল। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে কার্যকর অবদান রাখার জন্য দক্ষতার বিকল্প নেই। রাজনৈতিক কারণে তারা শৃঙ্খলা যথাযথভাবে মেনে চলার প্রতি কম গুরুত্ব দিতে পারে, এমন শঙ্কা রয়েছে এবং সেটা অমূলক নয়। বাংলাদেশের পরিদর্শন কার্যক্রমও গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। জনবল ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতা বাড়ানোর তাগিদও রয়েছে। এ অবস্থায় আরও ৯টি ব্যাংক!
নতুন ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার শর্ত যথেষ্ট কঠোর করা হয়েছে। তারা ঋণখেলাপি হতে পারবে না। আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে ভালো ট্রাক রেকর্ড থাকতে হবে। ব্যাংককে পারিবারিক কোটারিতে পরিণত করা চলবে না। কৃষি খাতে অন্তত ৫ শতাংশ ঋণ প্রদান করতে হবে। এসব শর্ত ভালো। তবে কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক হলেই যত বিপত্তি ঘটবে। আমানত সংগ্রহ করায় ইতিমধ্যেই অযথার্থ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনৈতিক প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। কিন্তু ঋণ প্রদানের মূল লক্ষ্য এখন পর্যন্ত হয়ে আছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারে যতটা না সহযোগিতা প্রদান তার চেয়ে ঢের বেশি মুনাফা অর্জন। ব্যাংকগুলোকে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। তারা মুনাফার হার বাড়িয়ে এ কাজ করবে, নাকি বিদ্যমান মুনাফার হার বজায় রেখেই তার একটি অংশ সেবামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করবে? নতুন ব্যাংকগুলো চালু হলে এ ধারায় ছেদ পড়বে, এমন প্রত্যাশা থাকতে পারে। কিন্তু তা পূরণ হবে তো? বাংলাদেশ ব্যাংক কি ঋণ ও আমানতের সুদের হারের ব্যবধান কমিয়ে আনায় সফল হবে? এসব ইস্যুর মীমাংসার পাশাপাশি আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ_ সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি। বিপুল সম্পদ এবং আমানতের নিরাপদ উৎস থাকার পরও তারা কিন্তু ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম :সিনিয়র
রিসার্চ ফেলো, সিপিডি

No comments

Powered by Blogger.