চারদিক-কালীগঙ্গায় মৎস্য শিকার by ইমরান উজ-জামান

পুবের চরের দৃশ্যটা আজ একটু অন্য রকম। মুরগি ঢেকে রাখার পলো বা খাঁচা কাঁধে চারদিক থেকে মানুষ আসছে। মুন্সিগঞ্জের চরাঞ্চলে বাঁশের তৈরি এই জিনিসকে ‘পলো’ বলে। টরকী, গুয়ের চর, নাকডাকার চর, খাশকান্দি ও ফুলতলার খেত মাড়িয়ে আসছে তারা। সবাই এসে পৌঁছাতে হবে, না হলে মাছ ধরতে পানিতে নামা যাবে না।


প্রতিবছর চৈত্র ও বৈশাখ মাসে এমন মাছ ধরার আয়োজন কয়েকবার হয় কালীগঙ্গায়। এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে এই মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। ঘোষণা দিয়ে প্রতি শুকনো মৌসুমে এলাকার সব মানুষ একসঙ্গে মাছ শিকার করে মুন্সিগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীতে। ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে কাঁপন ধরে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে যখন নদীর পানি একেবারে তলার কাছাকাছি চলে যায় এবং নদীতে হাঁটুপানির মতো থাকে, ওই সময়ে এলাকার সব মানুষ একসঙ্গে সারা নদী চষে মাছ শিকার করে।
কালীগঙ্গায় মাছ ধরার দিন ঠিক করা হয়। সেই খবর এলাকার সব মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে দেওয়া হয় আগের দিন। সে মতোই এলাকার সব ছেলে-যুবক-বুড়ো তৈরি হয়ে থাকেন। সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, কে বেশি বড় মাছ ধরবে। দুপুর থেকেই শুরু হয় মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি। মাথায় তেল মেখে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে নিয়ে হইহই ধ্বনির অপেক্ষা। ধ্বনি হতেই লুঙ্গি কোমরের সঙ্গে গামছা দিয়ে আঁটোসাঁটো করে বেঁধে কাঁধে পলো নিয়ে রওনা দেন প্রতিটি বাড়ির পুরুষেরা। গন্তব্য কালীগঙ্গা।
সূর্য তখন মাথার ওপর। এলাকার লোকেরা নদীর দুই পারে দাঁড়িয়ে। পেছনে আরও মাছ শিকারি আসছে। সবাই এসে পৌঁছালেই নামা হবে নদীতে। কে যেন একজন বলছে, ‘এভাবে নদীর পারে এসে বসে থাকলে কী হয়?’ অন্যজন বলে, ‘আরে, এট্টু (একটু) দেরি করো, সবাই আসুক।’ বলতে বলতে প্রায় সবাই এসে হাজির হয়েছে। মুহূর্তেই জোরে হইহই রব ওঠে। হইহই রবটা হলো সবাই যে প্রস্তুত, তার জানান দেওয়া। সমস্বরে চিৎকারে গ্রামের বউ-ঝিয়েরা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা এমন যে এলাকার সব পুরুষ খেলায় নেমেছে, আর ঘরের বউ-ঝিয়েরা তা দেখছে চারদিকের গ্রাম থেকে। ঠিক স্টেডিয়ামে যেভাবে মানুষ খেলা দেখে।
হইহই রবে সবাই একসঙ্গে নামে কালীগঙ্গার পানিতে। কেউ কেউ আবার নামার আগে পানি মুখে মেখে নেয়। নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত সারি করে সব মাছশিকারি দাঁড়িয়ে। ‘আলী আলী’ স্বরে তারা পলো ওপরে উঠিয়ে আবার ঝপ করে পানিতে ঠেসে ধরে। পলোর ভেতরে মাছ পড়লে সে ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করে। পলো চেপে ধরে রেখে পলোর ওপরে থাকা মুখ দিয়ে হাত ঢুুকিয়ে খুঁজে আটকে পড়া মাছকে ধরতে হয়। একজন একটা মাছ ধরে আর চিৎকার করে জানান দেয় সবাইকে। সবাই তাতে উজ্জীবিত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝপঝপ পলো ফেলে যায় পানিতে। এক হাতে মাছ ধরে পলো কাঁধে নিয়ে চিৎকার করতে থাকে একেকজন। ক্ষণে ক্ষণে চলে চিৎকারের খেলা। কেউ কিন্তু মাছ ধরা থামায় না। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই মাছ ধরার খেলা। মাছ ধরার সময়ে কালীগঙ্গার রূপ বদলে যায়। মাছশিকারি দলের সামনের পানি দেখতে স্বচ্ছ আর টলমলে। কিন্তু পেছনের পানি কাদায় মেখে ঘোলা হয়ে থাকে। পলো দিয়ে চষে চষে এলাকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় গিয়ে মাছ ধরা শেষ হয়। বিশাল জায়গা, দুপুরে শুরু করে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পশ্চিম আকাশে যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে কাঁধে পলো আর হাতে মাছের গোছা নিয়ে বাড়ি ফিরে মাছশিকারিরা।
বছরের পর বছর কালীগঙ্গায় মাছ শিকার করে আসছেন গুয়ের চরের মকিম গাজী। তিনি বলেন, তিনি তাঁর দাদা-বাবাকে দেখেছেন মাছ শিকার করতে। মাছ ধরার ডাক পড়লে ঘরে থাকতে পারেন না। ঘোষণা হলেই পলো কাঁধে কালীগঙ্গার পারে ছোটেন। এটা একসময় এই এলাকার উৎসব ছিল বলে জানালেন মকিম গাজী। তখন এখনকার মতো মাইকের প্রচলন ছিল না। সাপ্তাহিক হাটের দিন মাছ শিকারের তারিখ বলে দেওয়া হতো। হাট থেকে সবার মুখে মুখে এলাকার সব গ্রামে চলে যেত খবর। মাছ শিকারের দিন আসার আগ পর্যন্ত এলাকার হাটে-মাঠে-ঘাটে সর্বত্র মাছ ধরার গল্প চলত। প্রস্তুতি নিয়ে সবাই এসে হাজির হতো কালীগঙ্গার পারে। যারা ধরেছে তাদের তো থাকতই, যারা মাছ ধরতে যেতে পারত না তাদেরও মাছ দেওয়া হতো সমান ভাগ করে।
ইমরান উজ-জামান

No comments

Powered by Blogger.