গদ্যকার্টুন-ফাল্গুন, ভালোবাসা, পুঁথি ও মুখপুঁথি by আনিসুল হক

যৌবনে দাও রাজটীকা। লিখেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর উপলক্ষ ছিল বসন্ত। আগের জমানায় খুব বসন্ত দেখা দিত। জলবসন্ত নয়, রীতিমতো গুটিবসন্ত। সেই বসন্তে আক্রান্ত হলে বাঁচার আশা ছিল খুব কম। তারপর বসন্তের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হলো।


যৌবনে তাই রাজটীকা অর্থাৎ সরকার কর্তৃক বিনি পয়সায় বিতরণকৃত টিকা দেওয়া স্বাস্থ্য ও আয়ুর জন্য উপকারী বলেই বিবেচিত হতো। এখন অবশ্য বসন্ত নির্মূল হয়ে গেছে। এখন অন্যান্য রোগের টিকা নেওয়া আবশ্যক বলে বিবেচিত হলেও বসন্ত রোগের টিকা নেওয়ার দরকার পড়ে না।
তবে ঢাকা শহরের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে যে বসন্ত, সেটাও নির্মূল হওয়ারই পথে। গাছগাছড়া বলতে তো আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না এই শহরে। ইশ্, বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবন নামের বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর রমনার কী অপূর্ব বর্ণনাই না আছে! ঢাকাকে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন ‘উদ্যাননগরী’।
তবে গাঁদাফুল বিস্তর চোখে পড়েছে এবারের পয়লা ফাল্গুনে। চাষের গাঁদা, নিশ্চয়ই গাদা গাদা ফলে, আর সারা বছরই পাওয়া যায়। তবু তো ফুল। এইখানে মনে পড়ে যায় প্রয়াত কবি সমুদ্র গুপ্তের একটা দুই লাইনের কবিতা: ‘আমি বললাম, ফুল। তুমি বললে, ফুল, ও তো কাগজের। আমি বললাম, তবুও তো ফুল, লোকটা তো কাগজ দিয়ে বন্দুকও বানাতে পারত।’ সেই। চাষের ফুল হোক আর বাগানের ফুল হোক, ফুল না ফলিয়ে লোকে তো বারুদের দোকানও দিতে পারত।
আহা, টার্টল্স ক্যান ফ্লাই নামের ছবিটার কথা মনে পড়ছে। পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চাগুলো, রোজ খেতে যায়, লাইন করে আমাদের কিষানেরা যেমন নিড়ানি দিয়ে ঘাস তোলে, ওরা, ওই শিশুরা তেমনি করে মাইন বা বোমা তোলে। সেসব তুলে তারা বিক্রি করে। ইরানে, ইরাকে—এসব এলাকায়। ওই শিশুদের বেশির ভাগেরই পা নেই, হাত নেই। বোমায় উড়ে গেছে। চা-বাগানের শ্রমিকদের মতো মাইনগুলো সারা দিন তুলে দিনের শেষে সেসব জমা দিয়ে তারা টাকা গুনে নেয়।
আমি এই লেখাটা লিখছি ১৪ ফেব্রুয়ারিতে, ভ্যালেন্টাইন দিবসে। লোকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এই যে ভ্যালেন্টাইন ডে, এটা তো বিদেশি অপসংস্কৃতি, এটাকে আপনি কী চোখে দেখেন। আমি বলি, ভাই, এক দিন ভালোবাসব, আর কোনো দিন বাসব না, তা তো না, প্রতিটা দিনই ভালোবাসা দিবস, তবু ভালোবাসা দিবস পালন করছে, সেটা তো ভালোই, লোকগুলো তো ঘৃণা দিবস বা যুদ্ধ দিবসও পালন করতে পারত। ছোটবেলায় আমাদের একটা স্কুলপাঠ্য কবিতা ছিল:
ও ভাই ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে,
গোলাগুলির গোলেতে নয়, গভীর ভালোবেসে।
ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়,
সে যে সৃজন পরিচয়।
কাজেই আমি ভালোবাসা দিবসের ভালো দিকটাকেই দেখি, গোলাগুলির বদলে সবাই গলাগলি করুক, আমি তো তা-ই চাই। নারী-পুরুষও পরস্পরকে ভালোবাসুক না! রফিক আজাদের কবিতায় আছে, ‘তিনি দেখতে চান, তার প্রত্যাশা হলো, ঘরে ঘরে শুয়ে আছে নির্বিরোধ পুরুষ-রমণী।’
এবার বইমেলায় একটা বই বেরিয়েছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের, বহে জলবতী ধারা (২য় খণ্ড), সময় প্রকাশন থেকে। তাতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উল্লেখ করেছেন তাঁদের সময়ের নারীবর্জিত পৃথিবীর কথা, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে কথা বললে এক আনা জরিমানা হতো। কিন্তু তিনি লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সপ্তাহে মঞ্চে উঠে কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অংশ নিতেন, শুধু একটি ছাত্রী গোল গোল চোখ নিয়ে দর্শকসারিতে বসে থাকবে, এই আশায়। নারীরা চিরটাকাল নিজের অজান্তেই পুরুষদের প্রেরণা দিয়েছে। হয়তো নারীদেরও পুরুষরা দিয়ে থাকবে।
বইমেলায় বর্ধমান হাউস চত্বরের আমগাছটায় এবার মুকুল আসেনি। কোকিলের গানও এখনো শুনতে পাইনি মেলায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ফাল্গুনের প্রথম প্রহরগুলোকেই মনে হচ্ছে নিদাঘ চৈত্রদুপুর বলে। অথচ ছোটবেলা থেকেই যে শুনে আসছি, এক মাঘে শীত যায় না। এবারের শীত কি মাঘ আসার আগেই চলে গেল?
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চনফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল। আমের মুকুল বইমেলায় দেখিনি, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই অন্য গাছে দেখেছি। মুকুলের নিয়ম হলো, যত মুকুল ধরে, তত আম হয় না। বইমেলায় নাকি ভালো বই খুব কম। এটাও ওই একই সূত্র মানছে, অনেক বই বেরোবে ঠিকই, সব বই ঠিক বই হয়ে উঠবে না। তবে আমাদের প্রকাশকদের উচিত, এবার একটু বই প্রকাশনায় পেশাদারির দিকে মনোযোগ দেওয়া। পাণ্ডুলিপি বাছাই, সংশোধন, সম্পাদনা, প্রুফ রিডিং—নির্ভুল করে বইটা বের করা, এসবে কি তাঁরা একটু যত্ন নেবেন?
আবহাওয়া আসলেই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। এবার নাকি শীতকালে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। এই নিয়ে পরিবেশবিদ আর মৎস্যবিদদের মাথায় হাত পড়েছে। কী কাণ্ড কী কাণ্ড! শীতকালে কেন ইলিশ ধরা পড়বে!
বলছিলাম, সব বই বই নয়। সব পাঠকও তাহলে পাঠক নয়। কিন্তু কচুগাছ কাটতে কাটতে যেমন ডাকাত হয়ে যায় লোকে, একদিন চটুল বই পড়তে পড়তেই ছেলেরা সাবালক হয়, তখন তারা সিরিয়াস বইয়ের পাঠক হয়ে ওঠে।
তবে আমাদের দেশে সাবালকেরা বই পড়েন কম। বাসে-ট্রেনে এই দেশে লোকদের বই পড়তে দেখা যায় না। বিদেশে যাত্রীরা কিন্তু যানবাহনে, বিমানবন্দরে সারাক্ষণ বই পড়ে। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন একবার, ‘বয়স্ক পাঠকেরা গেলেন কোথায়?’
বয়স্ক পাঠকেরা বই না পড়লে আমাদের প্রকাশনা জগৎও প্রাপ্তবয়স্ক হবে না। শুধু কিশোরপাঠ্য বইই তারা বের করতে থাকবে।
তাই বলে বইমেলায় ভালো বই নেই, তাও নয়। সৈয়দ শামসুল হক আমাকে আমার কিশোরবেলায় বলেছিলেন (তিনি রংপুরে গেলে আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম, আজ থেকে বছর তিরিশ আগে) যে, ‘অনেকেই বলেন, এ দেশে ভালো বই পাওয়া যায় না। আমি তাঁদের বলি, আমাদের মধ্যে কজন বঙ্কিমচন্দ্র পুরোটা পড়েছি, কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরোটা পড়েছি?’
তাই তো। তাহলে তো বইমেলায় গিয়ে ক্লাসিকগুলো কেনা যায়। প্রতীক বা অবসরের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, বিভূতি, জীবনানন্দ দাশ, মীর মশাররফ হোসেন কি সবার কেনা হয়ে গেছে? কী বললেন, বইয়ের দাম বেশি! সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো বলতে হয়, কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা ওকথা, সিনেমার টিকিটের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে, নাকি ফুটবল খেলার টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে। এক হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা করে ক্রিকেট বিশ্বকাপের উদ্বোধনী টিকিটের দাম, আগের দিন থেকে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে। এই দেশের মানুষের টাকা নাই? চার কোটি মোবাইল যে দেশে, সে দেশে কেন চার কোটি বই বিক্রি হবে না?
ফাল্গুন থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে বইমেলা, বইমেলা থেকে বই, এই লেখাটা যে কোথায় যাচ্ছে? তবে ঘুরেফিরে বইয়েই আসি। বুক। ফেসবুক। মুখপুঁথি। ফেসবুক জিনিসটাকে আমরা যতই হেলাফেলা করি না কেন, এটা মোটেও হেলাফেলার জিনিস নয়। ফেসবুকের মাধ্যমেই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, এবং সেটা অবশেষে সংঘটিত হয়েছে। মিসরে ৩০ বছরের মোবারকি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ওরা বলছে, গণতন্ত্র মোবারক।
আমাদের দেশেও একটা ডিজিটাল প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। এটাকে অনেকেই এখনো হেলাফেলা করছেন। কিন্তু খোঁজ নিলে জানবেন, গত নির্বাচনে এরা ব্যাপকভাবে জনমত সংগঠিত করেছে। আগামী নির্বাচনেও করবে। শুধু নির্বাচন নয়, আমাদের বহু আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাপারে এই ফেসবুকাররা একটা শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে।
গত বছর, রস+আলোর মলাটের জন্য দুই লাইনের একটা বাণী রচনা করে দিয়েছিলাম। ওটার কপিরাইট এখনই দাবি করে রাখি—কথা নয় মুখে মুখে, ও ঝামেলা গেছে চুকে, কথা হবে এসএমএসে, কথা হবে ফেসবুকে। ফেসবুক নিয়ে আমার একাধিক কবিতা আছে। এর একটা, এবার যখন আমেরিকার আইওয়াতে যাই, একজন নিউইয়র্কার তরুণ কবি, সারা আকান্ত অনুবাদ করেছিলেন। আমার একটা লাইন ছিল, ‘ফেসবুকেও তোমাকে পেলাম না, না তোমার ফেইস, না তোমার বুক’...এখন বুকের অনুবাদ কী হবে? হূদয়, নাকি পুস্তক?
আসলেই, অনুবাদ করলে যা হারিয়ে যায়, তারই নাম কবিতা।
যা হোক, আমার পাঠকদের আমি বসন্তের ও ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলি, আসুন, বসন্তে ও ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনকে বই উপহার দিই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.