এই সময়-বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও দারাদ by প্রবীর বিকাশ সরকার

এত বড় একজন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার সাহস দারাদ কোত্থেকে পেল সেটাই বিস্মিত করেছে আমাদের! যে প্রবাসীরা প্রচণ্ড পরিশ্রম আর নানাবিধ প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলছে সে প্রচেষ্টাকে অসম্মান করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে! তার এই প্রতারণার যথার্থ বিচার আমরা জাপান প্রবাসীরা সরকারের কাছে দাবি করছি।


আমরা চাই না, এই দুষ্কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাপানি সমাজে কলঙ্কিত হোক


গত ২৮ জুন দৈনিক প্রথম আলোতে 'বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' শীর্ষক দুটি প্রতিবেদন পড়ে যুগপৎ বিস্মিত এবং লজ্জিত হয়েছি। এই কেন্দ্রটি স্থাপনের নামে যে অধ্যাপকের সাড়ে ৬ কোটি টাকা আত্মসাতের কথা বলা হয়েছে তার প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হয়নি, যে কারণে বাংলাদেশিরা ধরে নিতে পারেন তিনি একজন সাধারণ জাপানিই হবেন। সেই অধ্যাপকের নাম কাজুও আজুমা। তিনি জাপান শীর্ষ রবীন্দ্র গবেষক, বাংলা ভাষা ও বাঙালিপ্রেমী হিসেবে সুপরিচিত। তিনি জাপানি ও বাংলায় রবীন্দ্রনাথ এবং খ্যাতিমান বাঙালিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন জীবনের ৪০ বছরের বেশি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত উলেল্গখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ রচয়িতা, অনুবাদক। জাপান-বাংলা-ভারত শতবর্ষ সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য বিশ্বভারতীর 'দেশিকোত্তম', পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'রবীন্দ্র পুরস্কার', জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক 'ঙৎফবৎং ড়ভ ঃযব ঝধপৎবফ ঞৎবধংঁৎব' ছাড়াও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা তিনি পাননি একমাত্র ২০১০ সালে বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপ ছাড়া, যা তার গুণগত কর্মকাণ্ড ও অবদানের তুলনায় নিতান্তই কিঞ্চিৎকর।
অধ্যাপক কাজুও আজুমা এবং তার সহধর্মিণী কেইকো আজুমা দু'জনেই রবীন্দ্র ও বাঙালি অন্তপ্রাণ। কেইকো আজুমা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের ওপর এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন। জাপানিদের বাংলা শিখিয়েছেন। উভয় বাংলার কত বাঙালি যে তার বাঙালি রান্না খেয়েছেন তার হিসাব নেই! রবীন্দ্রসঙ্গীতও তার কণ্ঠস্থ। আজুমা স্যার প্রায়ই এ লেখককে বলতেন, 'আবার যদি মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করি, তাহলে বাঙালি হয়ে জন্মাতে চাই।' রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যার প্রথম পরিচয় 'ডাকঘর' পড়ে সেই কৈশোরে। সেই যে গুরুদেবকে জীবন-পথের সঙ্গী করে নিলেন আজও মৃত্যুশয্যায় তার ধ্যানেই মগ্ন। কর্মজীবনের দীর্ঘ ইতিহাসে তিনি ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ছিলেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানে জনমত ও অর্থ তহবিল গঠনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। স্বাধীন হওয়ার পরপরই প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণ বন্ধু অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশার খোঁজে। ১৯৭২ সালে গঠন করেন 'জাপান টেগোর সমিতি' এবং তারই উদ্যোগে বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির অনুবাদ ১২ খণ্ডে প্রকাশ। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরকালে তার দোভাষী এবং তত্ত্বাবধায়ক, সেই থেকে তারা ছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ১৯৯৩ সালে 'আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা' গঠন করে টোকিওতে দুটি সম্মেলনের আয়োজন করেন তাতে উভয় বাংলার খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা আমন্ত্রিত হন। ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেন 'নিপ্পন ভবন' জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, যা ছিল কবিগুরুর স্বপ্ন। ২০০৭ সালে তারই উদ্যোগে কলকাতার সল্টলেকে 'ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র' তথা 'রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন' প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোও। অনুরূপ 'বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' তিনি সিলেটে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কবিগুরুর সিলেট ভ্রমণ এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মস্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। আদৌ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবাদ এবং শান্তিবাদী আদর্শের অনুসারী, যে কারণে ২০০৪ সালে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়ের বিপদের কথা চিন্তা করে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন! বিরোধী দলনেত্রী শেখ হাসিনার প্রেরিত চিঠি অসুস্থ অবস্থায় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এমনি হৃদয়বান শুভাকাঙ্ক্ষী তিনি বাংলাদেশের!
সেই আজুমা স্যার সম্ভাবনাময় প্রকল্পটি ২০০৫ সালে দারাদ আহমেদকে স্থাপনের দায়িত্ব দেন। অকার্যকর দুটি কিডনি নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১২ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের বড়লেখা গ্রামে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী, জাপানি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তোমোকো কাম্বে, রেডিও-জাপান 'এনএইচকে'র বাংলা বিভাগের প্রধান কাজুহিকো ওয়াতানাবে প্রমুখ। ফিরে এসে আমাকে কয়েকটি ছবি ও প্রকল্পের দলিলপত্র দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের কাগজে একটি প্রতিবেদন লিখতে কেন কেন্দ্রটি ঢাকা না হয়ে সিলেটে হচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে একটি বড় প্রতিবেদন লিখি। সেটা পড়ে তিনি খুব খুশি হন। তখন দারাদের প্রসঙ্গ উঠতে তিনি একদিন আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিন দারাদ আমাকে জানায়, সে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের ছাত্র ছিল তখন থেকেই আজুমা স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। জাপানে আজুমা স্যারের সহযোগিতা নিয়ে পিএইচডি করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে জাপানি এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছে এবং স্যারের সাহায্যে স্থায়ী ভিসা পেয়েছে। মুদির দোকানও করেছে। নিউইয়র্কে মিউজিক কনসার্ট করে থাকে। তাদের পরিবার খুব বড়, তার মা ডাক্তার, অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তার আপন চাচা। তার মা তাকে জাপানে টাকা পাঠায় ইত্যাদি ইত্যাদি। যা সবই আসলে মিথ্যা। কিন্তু আজুমা স্যারের মতো আমিও সেসব বিশ্বাস করেছি। মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হলে বলত, প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। সময়মতো উদ্বোধন হবে। স্যার বিছানাশ্রয়ী হলেও তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সে করবে। এভাবে যায় দুটি বছর।
২০০৭ সালে ঘটা করে 'ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্রে'র উদ্বোধন হয়, স্যার সেখানে যান। আমাকে একদিন জানান তার খুব ইচ্ছা ছিল একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। ২০০৯ সালে দারাদের সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হলে জানায় : প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষ হয়ে আছে, উদ্বোধন করানোর মতো মন্ত্রী খুঁজে পাচ্ছে না। সেটাও আমি বিশ্বাস করি। আজুমা স্যার তখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তারের কড়া নিষেধ, সাক্ষাৎ করা যাবে না। আমি মাঝে মধ্যে টেলিফোন করে স্যারের খোঁজ নিই এবং কোইকো মাদামকে প্রকল্প সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাই না। আমতা আমতা করে বলেন, দারাদ যে কী করছে? কোনো ছবি বা সংবাদ আজ পর্যন্ত পাঠায়নি! আমার স্বামীর বড় ইচ্ছা ছিল কেন্দ্রটি দেখে যাওয়ার। আর তো তিনি নড়তে পারছেন না।
তখন যা বোঝার বুঝে গেলাম এবং অনেক দেরি হয়ে গেছে তাও বুঝতে বাকি রইল না। ২০১০ সালের ২ আগস্ট স্যারের ৭৯তম জন্মদিনের অভিনন্দন জানাতে হাসপাতালে গেলাম। স্যারকে দেখে দু'চোখে জল এলো। কী হৃষ্টপুষ্ট তেজদীপ্ত মানুষটি এতটুকুন হয়ে গেছেন! মুণ্ডিত মস্তক, নিঃসাড় বিছানায়, নিষ্পলক দৃষ্টি, কিছুই বলতে পারেন না। যে মুখে অনর্গল বাংলা শুনেছি! পাইপ দিয়ে তরল খাবার তাকে দেওয়া হয়। নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এলেন পুরনো বন্ধু পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস। আজুমা স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, রাষ্ট্রদূতসহ তাকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে, ২২ বছর পর মহামিলন ঘটল সুহৃদ আজুমা দম্পতির সঙ্গে। কায়েস ভাই জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মাধীন সময়ে তাদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তখন কেইকো মাদাম কয়েকটি ছবি দেখালেন কেন্দ্রের, যা আসলে বিভিন্ন কোণ থেকে তোলা একটি মসজিদবিশেষ। তা দেখে আমরা সকলেই মর্মাহত হলাম!
এত বড় অপকাণ্ড মারুবেনি কেলেঙ্কারির পর আর ঘটেনি। এত বড় একজন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার সাহস দারাদ কোত্থেকে পেল সেটাই বিস্মিত করেছে আমাদের! যে প্রবাসীরা প্রচণ্ড পরিশ্রম আর নানাবিধ প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলছে সে প্রচেষ্টাকে অসম্মান করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে! তার এই প্রতারণার যথার্থ বিচার আমরা জাপান প্রবাসীরা সরকারের কাছে দাবি করছি। আমরা চাই না, এই দুষ্কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাপানি সমাজে কলঙ্কিত হোক।

প্রবীর বিকাশ সরকার :জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক ও ছড়াকার
 

No comments

Powered by Blogger.