ছিটমহল-'মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ আমাকে নেবে না by নূরুননবী শান্ত

ছিটমহলের অধিবাসীরা নাগরিক হতে চান, ভোটার হতে চান। চান মানুষ হিসেবে মানবাধিকার পেতে। তারা কেবলই ছিটমহলবাসী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করার চেয়ে মৃত্যুই কামনা করেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা ১৮ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার জেমজুট এলাকার পুঁটিমারী ছিটমহলে সমবেত হয়ে টানা অনশন করেছেন।


১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের অর্ধশত প্রতিনিধি এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এত দীর্ঘ সময়ের অনশনে স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। বেশ কয়েকজন চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে। কিন্তু বাংলাদেশি নাগরিক না হওয়ায় হাসপাতালের আংশিক সেবা পেয়েছেন অনশনকারীরা। হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময় তাদের কোনো ছাড়পত্রও দেওয়া হয়নি। ফলে অনশনজনিত অসুস্থতা নিয়ে পরে কেউ আর হাসপাতালে যাননি। তারা অনশনস্থলেই স্যালাইন নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। ব্যানার-ফেস্টুনে বড় বড় করে লেখা ছিল, 'দাও নাগরিকত্ব, না হয় মৃত্যু'।
পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর কিংবা জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতিমালা ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দাদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে অপারগ। যদি ওরা যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেত, তাহলে অন্তত আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থাগুলোর মানবিক সাহায্য পেত। কিন্তু এটাই সত্য যে, ছিটমহলবাসী শরণার্থী নয়। তারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরের হলেও বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তাই বাংলাদেশের কোনো নাগরিক সুবিধা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে ভারত সরকারও তাদের প্রতি নূ্যনতম নাগরিক সুবিধা পেঁৗছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় না।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই ছিটমহল বিনিময়ের উদ্যোগ চলছে। ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তি চুক্তিমাত্রই থেকে গেছে। ১৯৭১ সালে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম হলো। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে তিন বিঘা করিডোর ও বেরুবাড়ী ছিটমহল বিনিময় করা হলো বটে, বাকি ১৬২টি ছিটমহল অপর রাষ্ট্রের ভেতরে বন্দি হয়েই থাকল। ১৯৯২ সালেও রাও-খালেদা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তারপর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ জরিপ এবং ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হাসিনা-মনমোহন প্রটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, হস্তান্তরের পর ছিটমহলের বাসিন্দারা বেছে নিতে পারবেন তাদের পছন্দের রাষ্ট্র। বাস্তবে ছিটমহল বিনিময়ের কোনো উদ্যোগের কথা আজ পর্যন্ত কোনো দেশের তরফ থেকেই শোনা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর এবং লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৬৯। ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বেষ্টিত বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১টি। এর আয়তন ৭১০ একর, লোকসংখ্যা ১৪ হাজার ২২১। ভারতীয় পক্ষ মনে করছে, হাসিনা-মনমোহন চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ভারতের হাতছাড়া হবে ১ হাজার ১৪৮ একর জমি। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার এটাই প্রধান কারণ বলে মনে করেন ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের নেতা ময়নুল-গোলাম মোস্তফারা। পৃথিবীতে মাটির দাম সত্যিই মানুষের চেয়ে বেশি। তাই তো ছিটমহলের মানুষ আজ পর্যন্ত নাগরিক হয়ে উঠতে পারেননি। তাদের কোনো রাষ্ট্রীয় পরিচয় নেই। ছিটমহলের একজন নারী দয়া বালা বলেন, 'ছিটের মেয়েদের মা হইতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। এখানে জন্ম নিয়ে একটা বাচ্চা বেঁচে থাকে সৃষ্টিকর্তার দয়ায়। কোনোদিন একটা টিকা জোটে না।' আরেক অনশনকারী আকবর আলী বলেন, 'আমি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার মেয়েকে বাংলাদেশের স্কুলে পড়াচ্ছি। মেয়ের মিথ্যা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে অনেক কৌশল করে বাংলাদেশের মাটিতে চার শতক জমিও কিনছি।' শুধু আকবর নয়, এই ছিটমহলগুলোর ধর্মপ্রাণ মানুষ পবিত্র হজ পালন করতে যান বাংলাদেশি নাগরিকের মিথ্যা পরিচয়ে! অনেকেই পাচার কর্মসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ধরা পড়লে মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করেন। ছিটমহলগুলোতে কোনো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থারই তেমন তৎপরতা নেই। ফলে নাগরিক পরিচয়ধারী অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে এই ছিটমহলগুলো। ভারত রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়েও এসব ছিটমহলের মানুষ ভারতে যায় লুকিয়ে। অক্সফাম ইন্ডিয়া পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে থাকা এ রকম প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পীড়নের অপপ্রচার চালায়। অপরপক্ষে, ভারতীয় প্রশাসন তাদের বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মনে করে।
ভারতের পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম বা বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে ছিটমহলবাসীর কোনো প্রবেশাধিকার নেই। তাই ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দারাও মানুষ হিসেবে তাদের মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন দাবিতে ১২ মার্চ থেকে ভারতের দিনহাটার সংহতি ময়দানে একই রকম আন্দোলন করেছেন। সব আন্দোলনকারীর একই দাবি_ হয় ছিটমহল বিনিময় কর, নয় ছিটমহলবাসীর নাগরিক সেবা নিশ্চিত কর। কিন্তু কেউ সে আন্দোলনে সাড়া না দেওয়ায় তারা হতাশ। গত ২৬ মার্চ তো ১১টি ভারতীয় ছিটমহলের বাড়ি বাড়ি বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। রাষ্ট্র স্বীকৃতি না দিলেও, তারা নিজেদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশ অংশের আন্দোলনকারীরা দাবি আদায় না হলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন।
রাষ্ট্রের আইন-নীতিমালায় যা-ই থাক, মানুষকে আত্মাহুতির দিকে এগিয়ে যেতে দেখেও বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই যেন চোখ-কান বন্ধ করে আছেন। পঞ্চগড় এলাকার রাজনৈতিক নেতারা পুঁটিমারীতে গেছেন। তারা অনশনকারীদের মন্তব্য খাতায় লিখে এসেছেন, 'বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ছিটমহলবাসীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে।... শৃঙ্খলিত ছিটমহলবাসীর মুক্তির সংগ্রামের প্রতি আমাদের সর্বাত্মক সমর্থন থাকল।' তাদের কথা অনশনকারীদের মনে সামান্য হলেও প্রশান্তি দিয়েছে। অবশেষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ফরিদা আখতার হিরা এমপি ১০ এপ্রিল অনশনকারীদের বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী ছিটমহলের বাসিন্দাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যথাশিগগির সম্ভব ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবেন। গোলাম মোস্তফা জানান, 'আমরা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে অনশন ভঙ্গ করলাম। কিন্তু আন্দোলন থামবে না। আমরা এরপর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গিয়ে আন্দোলন করব।' ওদিকে ভারতীয় অংশের ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেন মোবাইল ফোনে জানান, 'তারাও দিলি্ল এবং কলকাতায় গিয়ে অবস্থান নেবেন এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।'
ছিটমহলের অধিবাসীরা নাগরিক হতে চান, ভোটার হতে চান। চান মানুষ হিসেবে মানবাধিকার পেতে। তারা কেবলই ছিটমহলবাসী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করার চেয়ে মৃত্যুই কামনা করেন! দেয়ালে পিঠ কতটা ঠেকে গেলে দীপ্তিমানের মতো মানুষেরা বলতে পারেন_ 'মৃত্যু আমাকে নেবে/জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।'

নূরুননবী শান্ত :গল্পকার
shantonabi@gmail.com
রেটিং দিন :
 

No comments

Powered by Blogger.