মিসর-বিপ্লবের ভাগ্য জেনারেলদের হাতে? by রবার্ট ফিস্ক

হোসনি মোবারকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মিসরবাসী বিজয়লাভের দুই দিন পর মোবারকের আজীবন বন্ধু জেনারেল মোহামেদ এল-তানতাবির নেতৃত্বে সে দেশের সেনাবাহিনী গত রোববার পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ও সংবিধান স্থগিত করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় সেনাবাহিনীর কবজা আরও সংহত হলো।


আর তখন মিসরীয়দের উদ্দেশে মোবারকের নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক জেনারেল আহমেদ শফিক বলেছেন, তাঁদের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল ‘বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য’ ঠেকাতে ‘শান্তি ও নিরাপত্তা’। পতিত সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রায়ই এই স্লোগান উচ্চারণ করতেন। ওপরের পরিবর্তন থেকে ভেতরে বদলের কোনো ইঙ্গিত কি পাওয়া যায়?
কায়রোয় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ‘সামরিক পরিষদ’-এর প্রতিশ্রুতিকে সম্মান জানাতে সেনাসদস্যদের মরিয়া চেষ্টার অংশ হিসেবে হাজার হাজার সেনাসদস্য (যাঁদের অনেকেই নিরস্ত্র) তাহরির (মুক্তি) ময়দানে হাজির হন। সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের গত ২০ দিনের তাঁবু ছেড়ে যেতে আহ্বান জানান তাঁরা। শুরুতে জনতা তাঁদের বন্ধু বলে সম্ভাষণ জানায়, খাবার ও পানি সাধে। আবার লালটুপি মাথায় সামরিক পুলিশ নিরস্ত্র অবস্থায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রাজপথে নেমে আসে। হঠাৎ এক তরুণ কর্মকর্তা বিক্ষোভকারী জনতার ওপর বেত মারা শুরু করেন। উর্দি পরা তরুণদের বহুদিনের অভ্যাস সহজে যায় না। ২৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশের তাণ্ডবের পর যে জনরোষ দেখা গিয়েছিল, কিছুক্ষণের জন্য তারই ছোটখাটো পুনর্মঞ্চায়ন হয়ে গেল।
যারা মোবারককে উচ্ছেদ করল, তাদের বিজয়ের ফল হয়তো সেনাবাহিনীর জেনারেলদের দ্বারা আত্মসাৎ হয়ে যেতে পারে—এমন উদ্বেগ বাড়ার প্রতিফলন এই ঘটনা। মূলত যে জেনারেলরা এখন সেনাবাহিনীর চালিকাশক্তি, তাদের প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা অর্জিত হয়েছে মোবারকের সময়েই। আগের কয়েকটি নির্বাচনের মতোই গত বছর পার্লামেন্ট নির্বাচনে এত বিপুল জালিয়াতি হয়েছে যে পার্লামেন্ট বিলুপ্তির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেনি। তবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো তারিখও জানায়নি ‘সামরিক পরিষদ’। যদিও জনগণ ভেবেছিল যে তেমন প্রতিশ্রুতিই তাদের দেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা এত দিন প্রেসিডেন্ট-ব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে একটি দলিল হিসেবেই সংবিধানকে গণ্য করেছে। তাই সংবিধান স্থগিত করার ঘটনাও মিসরবাসীকে আলোড়িত করেনি। অন্যদিকে মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তিকে সম্মান দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছ থেকে গদগদ অভিনন্দন পেয়েছে। সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, তারা মাত্র ছয় মাস ক্ষমতায় থাকবে। তবে ছয় মাস পর সামরিক শাসনের মেয়াদ বাড়ানো যাবে কি না, সে ব্যাপারে কোনো কথা তারা বলেনি।
জনগণকে সেনাবাহিনী যে ছাড় দিতে চায় বলে মনে হচ্ছে, তার সঙ্গে যারা মোবারকের পতন ঘটিয়েছে, তাদের দাবির স্পষ্ট পার্থক্য দেখা দিচ্ছে। রোববার তাহরির ময়দানের পাশে এক ছোট জমায়েতে বেশ কতগুলো দাবি উঠে এসেছে। মোবারকের জারি করা জরুরি আইন বাতিল এবং কারাবন্দীদের মুক্তি এসব দাবির অন্তর্ভুক্ত। সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, জরুরি আইনের বিধান বাদ দেওয়া হবে ‘যখন ঠিক সময় আসবে’। কিন্তু এই আইন যত দিন বলবৎ থাকবে, তত দিন সব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে থাকবে। এই একই ক্ষমতা মোবারকের হাতেও ছিল। সেদিন তাহরির ময়দানে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে ছোট ছোট সংঘর্ষ ঘটার তাও এক কারণ।
রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে সেনাবাহিনী সন্দেহজনক নীরবতা পালন করছে। কেন এই নীরবতা? আগের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বন্দীদের কেউ কেউ খুব ভালো ধারণা রাখে বলে? কিংবা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ও পালিয়ে আসা বন্দীরা কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে এসে মরুভূমির তাঁবুতে (জনশ্রুতি অনুযায়ী) সেনাসদস্যদের দ্বারা নির্যাতন ও হত্যার যেসব ভয়ানক বিবরণ দিচ্ছে, সেই কারণে? দি ইনডিপেনডেন্ট-এর পরিচিত মিসরীয় এক সেনা কর্মকর্তা জোর দিয়ে বললেন, মরুভূমির কারাগারগুলো পরিচালিত হয় সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট দ্বারা। এসব ইউনিট প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশের যেসব শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা অধীনস্থ বাহিনী ও তাদের অনুগত সাদা পোশাকের ‘বালতাগি’ মাস্তানদের মিসর বিপ্লবের প্রথম সপ্তাহে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, তারা বরাবরের মতো বিমানে চড়ে সম্ভবত পালিয়েছে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে। কায়রো পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের এক কর্মকর্তার মতে, সেই সহিংসতায় তিন শতাধিক মিসরীয়র মৃত্যুর জন্য দায়ী কর্মকর্তারা পরিবার-পরিজনসহ আবুধাবিতে পালিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের পেটানোর জন্য পুলিশের ভাড়া করা মাস্তানরা এখন ঘাপটি মেরেছে। তারা ভালোমতোই জানে যে কখন তাদের আবার দরকার হবে। অন্যদিকে মধ্য সারির পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের বিচারকাজের গতিপথ কোন দিকে যায়, তা দেখার অপেক্ষায়। অবশ্য আদৌ যদি এই বিচার হয়।
এই বিচারকাজ নির্ভর করছে শাসকের ফেলে যাওয়া দলিলদস্তাবেজের আকার এবং বর্তমান কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সেনাবাহিনী তার কতটুকু বিচার বিভাগকে দিতে প্রস্তুত, তার ওপর। ২৮ জানুয়ারি নগর পুলিশ দপ্তরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় নগর পুলিশেরা সেখানে লুকিয়ে ছিল। রোববার তারাও কায়রোয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়ে বেতন বাড়ানোর দাবি তুলেছে। পুলিশ এখন বিক্ষোভকারীর ভূমিকায় নামবে—তারাই এখন বাড়তি বেতন পাবে—সেটাই বিপ্লব-উত্তর মিসরের এক অক্ষয় মুহূর্ত।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে মিসর বিপ্লবের কী প্রভাব পড়ে, মিসরের এখন তা দেখার পালা। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তৃতীয় দিনের মতো প্রতিবাদ এবং পুলিশি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তা ঠেকানোর চেষ্টা হলো রোববার। এই খবর জানে না এমন পরিবার মিসরে খুঁজে পাওয়া বর্তমানে কঠিন। মিসর ও প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে কী অসাধারণ মিল দেখা যাচ্ছে! মিসরে সফল আন্দোলনকারীদের অনুকরণে অন্য আরব দেশগুলোয় বিক্ষোভ হচ্ছে আর প্রতিক্ষেত্রে শাসকেরা মোবারকের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাযন্ত্রের পান্ডাদের ব্যর্থ কৌশলই বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসরণ করে চলেছে।
মিসরের অভিজ্ঞতার অনুকরণের আরেক পরিহাস হলো, যেসব আরব স্বৈরাচার নিজের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করে (শুরুতেই মনে আসে আলজেরিয়ার নাম, তারপর লিবিয়া ও মরক্কো), তারা সফল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য মিসরকে অভিনন্দন না জানিয়ে বরং জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়েছে। মিসরের বিপ্লবকে অভিনন্দিত করার অর্থ, বলা বাহুল্য, নিজের সিংহাসনের পায়েই কুঠারাঘাত করা।
১৪ ফেব্রুয়ারি
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ আহসান হাবীব।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.