কালের মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা by ফকির আলমগীর

উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে শুরু করছি আমার লেখা_ 'তোমার ঢাকের শব্দ আজও দ্রিমি দ্রিমি বাজে তোমার দেহই তোমার ঢাল আফ্রিক ...।' আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, বর্ণবাদবিরোধী গণতন্ত্রকামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ৯৩ বছর পূর্ণ হলো ১৮ জুলাই।


জীবনভর সংগ্রাম করেছেন মানুষের মুক্তির জন্য। প্রায় ২৮ বছর জেল আর নির্বাসন। আফ্রিকার মহান এই মুক্তিসংগ্রামী আজ আফ্রিকার ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস। নেলসন ম্যান্ডেলা একালের বিস্ময়। এই জটিল-কুটিল অসাধারণকালে কোনো রাষ্ট্রনেতা বিশ্বরাষ্ট্র নায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারেননি_ একমাত্র ব্যতিক্রম একালের মহানায়ক দিব্যজ্যোতি ম্যান্ডেলা। তার ক্যারিশমাও তাকে শুধু স্বকীয় চরিত্র বৈশিষ্ট্যেমণ্ডিত করেনি_ তার দর্শন ও জীবন সাধনাকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রিকতা। মানবমুক্তি ও স্বাধীনতাকে জীবনের মূলমন্ত্র ধরে তিনি বাধার পর বাধার পাহাড় ডিঙিয়েছেন ধৈর্যে, সহিষুষ্ণতায়, দৃঢ়চিত্তে। ফলে মানুষের আত্মিক জয় আর ম্যান্ডেলার সাধনা একাত্ম হয়ে গেছে। ম্যান্ডেলার বড় কীর্তি হচ্ছে, তিনি স্বাধীনতা, শান্তি আর সুন্দর জীবন প্রত্যাশা, মানুষের আশা-প্রত্যাশা ও স্বপ্নকে ইতিহাসের সঙ্গে মেলাতে পেরেছেন। এখানেই তিনি ইতিহাসে অনন্য। ম্যান্ডেলা আজ তাই ঐক্যের প্রতীক, গণতন্ত্রের প্রতীক, স্বাধীনতার প্রতীক, সৃজনশীলতা আর ধৈর্যের প্রতীক। ম্যান্ডেলাই কৃষ্ণ আফ্রিকাকে তুলে এনেছেন সম্মানের আসনে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত আফ্রিকা কবিতায় কালো আফ্রিকায় সূর্যোদয়ের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সার্থক রূপ দিয়েছেন আফ্রিকার কালো লেনিন নেলসন ম্যান্ডেলা। তবে একদিনেই তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা হয়ে ওঠেননি। নেলসন ম্যান্ডেলা হয়ে ওঠার পথ ছিল সুদীর্ঘ। নানা বাধা ও কণ্টকে আকীর্ণ এবং রক্তমাখা চরণতলে সব বাধা মাড়িয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, এগিয়ে গেছেন আর এমনি পথযাত্রায় তিনি রচনা করেছেন দীর্ঘ কাফেলা। বর্ণবাদের কারাপ্রাচীর ভেঙে জীবনে দীর্ঘপথ বেয়ে আলোক প্রভাতে নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্ভাষণ সমকালীন বিশ্বের সুন্দরতম ও আধুনিকতম ঘটনা। আজও দেখি এই প্রবীণ মানুষটি সর্বমানবের মুক্তির জয়গান অব্যাহতভাবে গেয়ে চলেছেন। তার ৯৪তম জন্মদিনে বিশ্ববাসীর সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও গাইতে চাই সেই জনপ্রিয় গান 'কালো কালো মানুষের দেশে, ঐ কালো মাটিতে রক্তের স্রোতের শামিল, নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল।'
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করা ম্যান্ডেলার আসল নাম রোলিশালা দালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা। স্কুলের এক শিক্ষক তার নাম দিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৪৩ সালে আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সঙ্গে যুক্ত হয়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এক পর্যায়ে বর্ণবাদবিরোধী মুক্তি সংগ্রামেরই প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬২ সাল থেকে জেল খেটেছেন। নব্বইয়ে মুক্তি মেলে তার। বর্ণবাদের অবসান হয় আফ্রিকায়। ১৯৯১ সালেই এএনসির প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আফ্রিকার বহুদলীয় সরকারের প্রেসিডেন্ট হন। এর আগে ১৯৯৩ সালে অর্জন করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে আরেক বিরল দৃষ্টান্ত গড়েন পৃথিবীর বুকে। রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই আফ্রিকান এই মহান নেতা শুরু করেন আরেক সংগ্রাম_ এইডসবিরোধী সংগ্রাম। আর সে সংগ্রামের জন্য তিনি গড়ে তোলেন ৪৬৬৬৪ নামের এই সংগঠন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি এখন বয়সের ভারে নতজানু হয়ে পড়েছেন। গত মাসে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। দু'দিন পরেই তাকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন চিকিৎসক। বিশ্লেষকদের মতে, ২৮ বছর কারাগারে থাকার জের এখনও টানতে হচ্ছে তাকে। তারপরও ম্যান্ডেলা মানেই সংগ্রামের ঝাঁঝালো গন্ধ, মুক্তির শ্বেত শুভ্ররূপ, লাঞ্ছিত-নিপীড়িতের পাশে উচ্চকিত কণ্ঠস্বর। অসুস্থ অবস্থার মধ্যেও ম্যান্ডেলা এখন কাজ করছেন আফ্রিকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
২০০৯ সালের ১৮ জুলাই প্রতিষ্ঠা লাভ করা নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের ব্যানারে তিনি মূলত সমাজসেবা তথা মানবসেবার কাজ করছেন। সময় কাটে পরিবারের সঙ্গে। একটু হাসি-গানে মেতে থাকতে চেষ্টা করেন। পরিশেষে তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
ফকির আলমগীর :গণসঙ্গীত শিল্পী
 

No comments

Powered by Blogger.