সেই রাতে বাড্ডার মার্কেটে আশ্রয় নেওয়া দুই ব্যক্তিকে অপহরণ! by পারভেজ খান ও আপেল মাহমুদ

নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর সন্ধান এখন পর্যন্ত মেলেনি। র‌্যাব-পুলিশসহ সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য রাজধানীসহ সারা দেশে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখলেও তারা এখনো ব্যর্থ। গোয়েন্দা সূত্র মতে, এটি সাধারণ কোনো পেশাদার চক্রের কাজ নয়।


এই নিখোঁজ রহস্যের সঙ্গে এমন কোনো চক্র জড়িত, যারা অনেক বেশি সতর্ক, সাবধানী, দক্ষ এবং বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হতে পারে তারা রাষ্ট্রের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার চেইন অব কমান্ড বা ট্রেইল ভাঙা গ্রুপ। এদের সঙ্গে সরাসরি নেপথ্যে থেকে কিংবা মদদ দিয়ে বাইরের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার লোকও থাকতে পারে। এর আগে পাওয়া বিভিন্ন ক্লুর সঙ্গে এই বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এদিকে কালের কণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার রাত (গত মঙ্গলবার রাত) আনুমানিক ১২টার দিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার মুসা মার্কেট (জিএম প্লাজা) থেকে দুই ব্যক্তিকে আটজন মোটরসাইকেল আরোহী অস্ত্রের মুখে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, অপহরণকারীরা প্রায় সবাই জিনসের প্যান্ট ও শার্ট-গেঞ্জি পরা এবং সশস্ত্র ছিল।
মার্কেটের অনেকের কাছ থেকেই এই তথ্য জানা গেলেও কেউ বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। বিশেষ করে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
ফজলু নামে মার্কেটের এক নিরাপত্তাকর্মী কালের কণ্ঠকে বলেন, রাত তখন আনুমানিক ১২টা বা কিছু এদিক ওদিক হবে। দুই ব্যক্তি দৌড়ে মার্কেটের ভেতরের একটি পরিত্যক্ত দোকানে ঢুকে সাটার বন্ধ করে দেন। এটি একটি কাপড়ের দোকান ছিল এবং গত মাসে ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায় এটি খালিই পড়ে ছিল। এর কিছুক্ষণ পর আট ব্যক্তি চারটি মোটরসাইকেলে করে এসে কিছু খোঁজাখুঁজি করে। তারা মার্কেটের কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাও করে। এ সময় মার্কেটের সব দোকানই বন্ধ ছিল। একপর্যায়ে তারা তালাবিহীন একটি দোকানের সামনে এসে দোকানের সাটারটি টেনে ওঠায়। এই দোকানেই ঢুকেছিলেন ওই দুজন। এ সময় মোটরসাইকেলে করে আসা আটজনের একজন বলে ওঠে, 'স্যার, আপনি এখানে কেন? এসি নেই, ফ্যান নেই। এখানে থাকবেন কিভাবে? চলুন, আপনার জন্য অন্যখানে ভালো ব্যবস্থা করা হয়েছে।' মোটরসাইকেলে আসা লোকজন ওই দুই ব্যক্তির একজনের সঙ্গে স্যার সম্বোধন করেই কথাগুলো বলে। তবে তাদের মধ্যে বেশ কয়েক মিনিট উচ্চ বাক্যবিনিময়ও হয়। একপর্যায়ে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ওই দুই ব্যক্তি তাদের সঙ্গে হেঁটেই মার্কেট থেকে বের হয়ে যান।
জানা যায়, যে মার্কেট থেকে এই দুজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি স্থানীয়ভাবে মুসা মার্কেট নামে পরিচিত। এটির আরেক নাম জিএম প্লাজা। মার্কেটটিতে পাইকারি মনোহারি ও মুদি মালের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। মার্কেটের এক দোকানমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রথমে দুই ব্যক্তি দৌড়াতে দৌড়াতে মার্কেটে ঢুকে একটি দোকানে আশ্রয় নেয়। গত মাসে ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায় দোকানটিতে কোনো মালামাল ছিল না। মিনিট দুয়েক পরেই আট ব্যক্তি এসে তাঁদের খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর তাঁদের না পেয়ে সশস্ত্র ব্যক্তিরা মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মীকে খোঁজ করে। তারা নিশ্চিত, দুই ব্যক্তি এ মার্কেটেরই কোথাও লুকিয়ে আছেন। পরে তারা নিরাপত্তাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটের ভেতরে অবস্থিত দোকানের সাটার খুলে একটি কাঠের টুলে বসা অবস্থায় একজনকে এবং দাঁড়ানো অবস্থায় আরেকজনকে খুঁজে বের করে।
প্রত্যক্ষদর্শী আরেক নিরাপত্তারক্ষী কালের কণ্ঠকে জানান, সশস্ত্র ব্যক্তিরা স্যার সম্বোধন করে ওই দুই ব্যক্তিকে তাদের সঙ্গে আসতে বললে প্রথমে তাঁরা রেগে যান। তখন বসে থাকা ব্যক্তি বলেন, 'কী কারণে আপনাদের সঙ্গে যাব? আপনারা কারা?' তখন সশস্ত্র ব্যক্তিদের একজন চড়াস্বরে বলে, স্যার, এমনিতে না গেলে আপনারই মানসম্মান যাবে। এর মধ্যে স্যার সম্বোধিত ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কথা বলতে চাইলে তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেয় একজন। এরপর আট ব্যক্তির মধ্যে চারজন মোটরসাইকেলে আর অন্য চারজন আটক দুই ব্যক্তিকে ঘিরে রেখে উত্তর বাড্ডার প্রধান রাস্তার দিকে চলে যায়। এ সময় কয়েকজন শ্রমিক তাদের দিকে এগিয়ে গেলে সশস্ত্র ব্যক্তিরা অস্ত্র উঁচিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে জানান, ধরে নেওয়া দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন মাঝারি গড়নের এবং মোটাসোটা ধরনের। আধাপাকা চুল, গোঁফ আছে। পরনে সাদার মধ্যে ডোরাকাটা হাফশার্ট। আরেকজন হ্যাংলা পাতলা, একটু লম্বাটে ধরনের। লম্বাটে লোকটির হাবভাব দেখে মনে হয়েছে, তিনি অপর ব্যক্তির অধীন্যস্ত কর্মচারী। তিনি তাঁর বসকে আগলে রাখার চেষ্টা করছেন। এক দফায় ওই অধীন্যস্ত ব্যক্তিটি সশস্ত্র ব্যক্তিদের একটু দূরে গিয়ে মোবাইল বের করে ফোন করার চেষ্টা করলে সশস্ত্র ব্যক্তিদের একজন তাঁকেও ধমক দিয়ে ফোনটি কেড়ে নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, তাঁরা গত কয়েক দিন পত্রিকায় ইলিয়াস আলীর ছবি দেখছেন। এখন কেন যেন তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে, সশস্ত্র ব্যক্তিরা যাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করেছিল, তাঁর সঙ্গে ইলিয়াস আলীর চেহারার মিল আছে। হতে পারে ওইজনই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী।
মঙ্গলবার মধ্যরাতে উত্তর বাড্ডায় এই সশস্ত্র মহড়া আর দুই ব্যক্তিকে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি এখনো এলাকাবাসীর কাছে রহস্যময় হয়ে আছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বাড্ডা থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওই এলাকায় গত মঙ্গলবার কোনো অপহরণ বা সশস্ত্র ব্যক্তিরা কাউকে তুলে নিয়ে গেছে, এমন ঘটনা তাঁদের জানা নেই। কেউ এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে থানায় আসেনি।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) খন্দকার হাসান মাহমুদ গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যাপারটি তাঁরা তদন্ত করে দেখবেন। তবে তাঁরা এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো তথ্য পাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্য বা তাঁর অবস্থান জানার জন্য দেশব্যাপী বিশাল জাল বা নেটওয়ার্ক বসিয়েছেন। আধুনিক নানা প্রযুক্তিও তাঁরা ব্যবহার করছেন। কমপক্ষে পাঁচ শ ব্যক্তির মোবাইল নম্বরের ওপর তাঁরা নজরদারি চালাচ্ছেন। কিন্তু এর পরও এখন পর্যন্ত তাঁদের জালে কেউ ধরা পড়া দূরে থাক, কারো ছায়া পর্যন্ত পড়েনি। ফলে তাঁরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে, এ ঘটনার নেপথ্য নায়করা অনেক বেশি কৌশলী।
কর্মকর্তারা জানান, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সোচ্চার ছিলেন ইলিয়াস আলী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস (বরখাস্ত) ওমর ফারুকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গেও কোনো না কোনোভাবে ইলিয়াস আলীর সম্পৃক্ততা আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এসব দানা বেঁধে ওঠা সম্ভাবনার মধ্যেই একটি হচ্ছে বিদেশি শক্তি বা কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার যোগসূত্র।
কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে, ইলিয়াস পরিবারের সদস্য কিংবা তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের কেউ কেউ অনেক তথ্যই জানেন। কিন্তু কোনো এক কারণে তাঁরা সেটা প্রকাশ করছেন না। গত শনিবার রাতে র‌্যাবের সঙ্গে গাজীপুরের পূবাইলে অভিযান চলাকালে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অদূরে গাড়িতে বসা। অভিযান ব্যর্থ হয়ে তাঁরা যখন ফিরে আসেন তখন লুনা ফিরে চলে যান খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। এরপর সেখান থেকে তিনি বাসায় ফিরে যান। প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে তিনি আর কোনো কথা বলেননি। শুধু এটুকুই বলেছেন, র‌্যাবের সঙ্গে অভিযানের সময় তিনি ছিলেন না। তিনি এ সত্যতা কেন গোপন করছেন, সেটাও রহস্যজনক।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ রহস্যটি খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তিনি জানতে পেরেছেন, র‌্যাবের সঙ্গে অভিযানে থাকার ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষমহল থেকে তাঁকে বলা হয়েছে, 'আপনার স্বামী ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে র‌্যাব। আপনি তাদের সঙ্গেই এ উদ্ধার নাটকে অংশ নিচ্ছেন! এটা করলে বিএনপি যে অভিযোগ আনছে, তার গুরুত্ব কমে যাবে। আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সংস্থার সঙ্গে পরে আর কোনো অভিযানে যাবেন না।' এ কথা বলার পর থেকেই পাল্টে গেছেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় তিনি এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কী করবেন? গতকাল রবিবার দুপুরেও র‌্যাবের কয়েকটি দল তাঁর বাসায় যান এবং লুনার সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি নতুন করে উল্লেখযোগ্য আর কিছু জানাতে পারেননি।
এদিকে ঢাকা মহানগর যুবদলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টার দিকে যুবদল নেতা আমজাদ, মুন্না ও তিনি ইলিয়াস আলীর সঙ্গে একই গাড়িতে করে রূপসী বাংলা হোটেলে যান। এ সময় তাঁদের পেছনে মোটরসাইকেলে জাহাঙ্গীর ও শরিফ নামে আরো দুজন ছিলেন। তাঁরা হোটেলের লবিতে বসে কথা বলেন। সেখানে হাবিব নামে ইলিয়াস আলীর একজন আইনজীবীর আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি না আসায় রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁরা সবাই লবি থেকে বের হয়ে আসেন। হোটেলের দরজার কাছেই দেখা হয় ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর খালাতো বোনের সঙ্গে। তিনি একটি প্রাডো গাড়ি থেকে নামছিলেন। সঙ্গে তাঁর স্বামী-সন্তানরাও ছিল। ইলিয়াস আলী তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েই কথা বলেন। এ সময় ইলিয়াস আলী টেলিফোন করে চালককে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেন এবং তাঁর গাড়িতে করেই বের হয়ে যান। এরপর আমজাদসহ তাঁরাও যে যার মতো চলে যান বলে মীর নেওয়াজ জানান।
মীর নেওয়াজ আরো জানান, সে সময় ইলিয়াস আলীর পরনে ছিল হালকা সাদা ও নীল ডোরাকাটা বুটিকের হাফহাতা শার্ট এবং ছাই রঙের ফুলপ্যান্ট। গাড়িচালক আনসারের পরনে ছিল জিনসের নেভি ব্লু প্যান্ট এবং বিস্কুট রঙের গেঞ্জি।

No comments

Powered by Blogger.