বিরল ভালোবাসা এবং আমার কিছু কথা by হায়দার আলী

২০১০ সালের ৪ এপ্রিল। সকালবেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে রমিজা খাতুন কাঁদলেন। বললেন, 'মরার আগে কাদিরের বাপ (হাসমত আলী) জমির দলিলডা হাতে দিয়া আমারে কইছিল, আমি মইরা গেলে আমার এতিম মাইডার কাছে (শেখ হাসিনা) জমির দলিলটা পেঁৗছাইয়া দিবি।


অহন দলিলডা তাঁর হাতে দিয়া যাইতে পারলে আমি মইরাও শান্তি পামু।' বৃদ্ধ রমিজা খাতুনকে কি বলে সান্ত্ব্তনা দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু এতটুকু বললাম, আমি আপনার এই আবদারটুকু পূরণ করতে পারব কি না জানি না, তবে আমি পত্রিকার পাতায় হাসমত আলী ও আপনাদের কথা তুলে ধরতে পারব। আপনাদের কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না হলেও অন্তত আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের কেউ না কেউ আপনার এই আবদার পূরণ করতে এগিয়ে আসবে। কথাগুলো বলতেই রমিজা খাতুনের দুই চোখ ভিজে ওঠে। শুধু তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে।
রমিজার হাতে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। ছুটে গেলাম গফরগাঁও উপজেলার খারুয়া বড়াইল গ্রামে। যেখানে হাসমত ঘুমিয়ে আছেন। কবরের কাছে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবি, একটু একটু করে সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকায় নিজের নামে নয়, একমাত্র ছেলে আবদুল কাদির কিংবা স্ত্রীর নামে নয়, তিনি জমি কিনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে! বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এত ভালোবাসতেন! পরে স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রি অফিস, হাসমত আলীর সহপাঠী ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় চলে আসি।
ভেতরে ভেতরে চরম উত্তেজনা অথচ ঢাকায় ফিরে আসার পরও কাউকে কিছু বলছি না! প্রতিবেদনটি লেখার সময় বারবারই রমিজার চিরদুঃখী মুখটা আমার সামনে ভাসতে থাকে। আর ভাবি, প্রতিবেদনটি কি কালের কণ্ঠ পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে? যদি তা ছাপা হয়, সেটা কি প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়বে? প্রধানমন্ত্রী কি কালের কণ্ঠ পত্রিকা পড়েন? নানা প্রশ্ন-শঙ্কা ভিড় করে মনের ভেতরে। খবরটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরও যদি রমিজার দলিলটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেঁৗছাতে না-ই পারি, তাহলে বৃদ্ধ রমিজাকে কি বলে সান্ত্বনা দেব? লেখা শেষ করে গত বছরের মে মাসের শেষের দিকে আমাদের সম্পাদক আবেদ ভাইকে (আবেদ খান) ঘটনাটি খুলে বলি এবং প্রতিবেদনটি দেখাই। আবেদ ভাই প্রতিবেদনটি পড়ে অবাক হয়ে বললেন, এটা তো চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা! আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে নিউজটি তিনি কালের কণ্ঠের নিউজ ম্যানেজমেন্টের সংশ্লিষ্টদের বলেন।
২ জুন ভোরে পত্রিকা দেখে হতবাক হয়ে যাই। প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম। সকাল সোয়া ৯টায় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকির ফোন। কিছুক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্তসচিব সেলিমা খাতুনের ফোন। দ্রুতই বদলে যেতে থাকে হাসমত আলীর স্ত্রী রমিজা খাতুনের জীবন।
৩ জুন বেলা ১১টায় যখন রমিজাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাই, ওয়েটিংরুমে বসে থাকি প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাছে আসতেই রমিজা কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। যেন হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে অনেক দিন পর ফিরে পেয়েছেন রমিজা। সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। দলিলের কপিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে দেওয়ার পর রমিজার পাশাপাশি আমিও যেন ভারমুক্ত হলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যে সাংবাদিক এত সুন্দর একটি প্রতিবেদন খুঁজে বের করে প্রকাশ করল, তাঁকেও পুরস্কৃত করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী বললেন, সকালে কালের কণ্ঠ পত্রিকা পড়েই আমি অবাক হয়ে যাই, হাসমত আলীদের মতো মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই আমার বাবা সারাজীবন রাজনীতি করেছেন, আমিও কিন্তু সেই আদর্শ নিয়ে চলছি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, তোমার এই সুন্দর সাংবাদিকতার জন্য আমি উপহারস্বরূপ এক লাখ টাকা দিচ্ছি। ওই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপা আমার পুরস্কার আমি পেয়ে গেছি, রমিজা খাতুন দলিলটা আপনার হাতে দিতে পেরেছে এবং দুই দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ মোবাইল ফোনে আমাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছে, এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে?
১৭ জুলাই জমির দলিল হস্তান্তর অনুষ্ঠানের একটি কথা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না, ভোলার কথাও নয়। সন্ধ্যার পর রমিজার নামে ফিরিয়ে দেওয়া জমির দলিলটি হস্তান্তর হবে। গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে জমির দলিলে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করছিলেন। ঠিক পেছনেই একসঙ্গে বসা ছিলাম আমি ও কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি ফারুক মেহেদী। দলিলে স্বাক্ষর শেষে রমিজার হাতে দলিলটি হস্তান্তরের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর মুখে উচ্চারণ, আমার কালের কণ্ঠের সাংবাদিক হায়দার আলী কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর মুখে আমার নাম শুনে চমকে উঠি, দ্রুত কাছে চলে যাই। তিনি আমাকে বললেন, রমিজার পাশে তুমি দাঁড়াও। আমাকে সামনে রেখেই রমিজার হাতে তুলে দিলেন জমির দলিল।
সবচেয়ে বড় চমক এবং বিরল ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রমিজার বাড়িতে গিয়ে। হাসমত আলীর সেই জমিতে নির্মিত বাড়িতে রমিজাকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রমিজাকে নিয়ে বাড়িটি ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। এই অভূতপূর্ব দৃশ্যের কথা এখনো ভুলতে পারছি না। ৩১ মার্চ বিকেলে গফরগাঁওয়ের জনসভায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কালের কণ্ঠ এবং আমার কথা তুলে ধরলেন সাধারণ মানুষের কাছে। বিরল ভালোবাসার গল্পটির যেন সফল সমাপ্তি হয়েছে। আমি যা প্রত্যাশা করেছি তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি পেয়েছি। সেই দুঃখী রমিজার মুখে এখন রাজ্যের হাসি, সুখের সীমা নেই। রমিজার কথা মনে হলে গর্বে বুকটা ভরে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হাসমত আলীদের মতো মানুষের ভালোবাসার কারণেই আপনি বেঁচে থাকবেন এবং বেঁচে থাকা দরকার। আপনার মঙ্গল কামনা করি।

লেখক : সাংবাদিক
haider_07ali@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.